যে মন্ত্রে করবেন দেবী শৈলপুত্রীর ধ্যান! ও অন্যান্য

আশ্বিন মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে (সর্বপিতৃ অমাবস্যা বা মহালয়ার পরদিন) দেবী শৈলপুত্রীর পূজার মাধ্যমে শুরু হয় নবরাত্রি উৎসব। ‘শৈলপুত্রী’ নামের অর্থ ‘পর্বতের কন্যা’; সেই অর্থে ‘পার্বতী’ ও ‘শৈলপুত্রী’ সমার্থক।

ইনিই দেবী কবচোক্ত নবদুর্গার প্রথম রূপ। কালিকাপুরাণ-এ উল্লিখিত চৌষট্টি যোগিনীর অন্যতমা হলেন শৈলপুত্রী। সেই ত্রেতা যুগের কথা, অযোধ্যার রাজা শ্রী রামচন্দ্র তাঁর স্ত্রী দেবী সীতাকে লঙ্কার নরপতি রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করতে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ৯ টি রাত ধরে শক্তির উপাসনা করেন।

৯টি রাতে আদ্যাশক্তি মহামায়ার ৯টি রূপ কল্পনা করেন তিনি। পুজা করেন যথা উপাচারে। পুরাণে বর্ণিত আছে মা দুর্গার এই নয়টি রূপ শুক্লপক্ষের নবরাত্রী তিথিতে নয়টি শস্যে অবস্থান করেন। এই নয়টি শস্যকে মায়ের নয়টি রূপ মনে করা হয়।

নবদূর্গার প্রথম রূপ শৈলপুত্রী। গিরি রাজের কন্যা বলে শৈলপুত্রী নামে খ্যাত হন। দেবী শৈলপুত্রী দ্বিভুজা–তাঁর এক হাতে পদ্ম, অপর হাতে ত্রিশূল। দেবীর মস্তকে অর্ধ্বচন্দ্র; বাহন বৃষ; ভৈরব শৈলেশ্বর।

পুরাণে কথিত আছে দক্ষযজ্ঞে দেবী ভগবতী সতী যখন শিবনিন্দা শুনে দেহত্যাগ করলেন, তখন মহাদেব ক্রোধে উন্মত্ত ও শোকে বিহ্বল হয়ে সেই দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে উন্মত্তের মতো সারা ত্রিলোক ঘুরতে লাগলেন।

ত্রিভুবন তাঁর তাণ্ডবনৃত্যে সন্ত্রস্ত কম্পিত হয়ে উঠল। বিশ্বের এই বিপদ সামলাবার জন্য নারায়ণ তাঁর সুদর্শন চক্রে শিবস্কন্ধস্থিত দেবীর শরীর একটু একটু কবে কেটে ফেলতে লাগলেন। দেবী দেহের সেই টুকরো যেখানে পড়ল সেখানে সৃষ্টি হল একান্নটি শক্তিপীঠ।

আর এদিকে ভাববিভোর শংকর তাঁর কাঁধে দেবীর শরীর না পেয়ে আত্মস্থ হয়ে কৈলাসে গিয়ে ধ্যানে বসলেন। শক্তি লাভের জন্য শুরু হল মহাদেবের তপস্যা।

অন্যদিকে স্বর্গরাজ্যে তারকাসুরের অত্যাচারে দেবতারা বিপন্ন হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলে তিনি বিধান দিলেন -উপযুক্ত সেনাপতির অভাবে তোমাদের এই পরাজয়। এই সেনাপতি হবেন,শিব-শক্তির মিলনের ফলে সৃষ্ট হবেন যিনি,সেই কুমার।

দেবতারা তখন দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়াকে কাতর হয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন – ‘মা, তুমি এসো, আবির্ভূত হও, শিবসঙ্গে আবার বিরাজিত হও-আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষার জন্য তোমার ও দেবাদিদেবের মিলনে একটি উপযুক্ত সেনাপতি আমাদের দান কর।’

দেবতাদের এই কাতর প্রার্থনায় মহাদেবী দুর্গা আবার মর্ত্যশরীর ধারনে স্বীকৃতা হলে। এর আগে নাগাধিরাজ হিমালয় ও পত্নী মেনকা স্বয়ং জগদম্বাকে কন্যারূপে পাওয়ার জন্য অনেক তপস্যা করেছিলেন।

এখন দেবতাদের ইচ্ছা ও হিমালয়ের প্রার্থনা পূর্ণ করবার জন্য দেবী পার্বতী হৈমবতী কন্যা হয়ে হিমালয়ের গৃহে জন্ম নিলেন। তখনই তাঁর নাম হল শৈলপুত্রী। এই দেবীর সৃষ্টি এইভাবেই হয়েছিল। ইনিই পরে শিবের জন্য তপস্যা তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে কার্ত্তিকের জন্মদান করেন।

আরো কিছু গ্রন্থ হতে পাওয়া যায় যে- একবার দেব ও অসুরের যুদ্ধে ব্রহ্ম দেবতাদের জয়ী করেছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মের শক্তিকে ভুলে দেবতারা জয়ের গৌরব নিজেরাই নিতে উদ্যত হলেন। ব্রহ্ম তখন নিজে এলেন দেবতাদের দর্পচূর্ণ করতে।

তিনি একখণ্ড তৃণ রাখলেন দেবতাদের সম্মুখে। কিন্তু দেবতারা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, অগ্নি সেই তৃণখণ্ডটি দহন করতে বা বায়ু তা একচুল পরিমাণ স্থানান্তরিত করতে অসমর্থ হলেন।

তখন ইন্দ্র এলেন সেই জ্যোতির্ময় ব্রহ্মকে জানতে। ব্রহ্ম অন্তর্হিত হলেন। ব্রহ্মশক্তি হৈমবতী রূপে ইন্দ্রের সামনে উপস্থিত হয়ে ব্রহ্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করলেন। দেবী শৈলপুত্রী সম্পর্কে বর্ণিত আছে কালিকা পুরাণে। হৈমবতী নামটি আবার বর্ণিত আছে সামবেদীয় কেন উপনিষদ্-এ।

স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানামুমাং
হৈমবতীং তাং হোবাচ কিমেতদ্ যক্ষমিতি।। (কেন, ২৫)

(তিনি [ইন্দ্র] সেই আকাশেই স্ত্রীরূপিণী পরমারূপবতী হৈমবতীকে [আবির্ভূত হতে দেখে তাঁর] নিকটে গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই পূজনীয় স্বরূপ কে?’)

তবে, উপনিষদ হৈমবতী ও পৌরাণিক শৈলপুত্রী দুই পৃথক দেবী। ‘হৈম’ শব্দের অপর অর্থ হিরণ্ময় বা সোনার মতো উজ্জ্বল। সম্ভবত ব্রহ্মশক্তির জ্যোতির্ময়ী রূপটির কথা স্মরণ করেই উপনিষদে ‘হৈমবতী’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে; এর সঙ্গে হিমবৎ পর্বতের কোনো সম্পর্ক নেই। উপরন্তু তন্ত্রে দেবতাদের দর্পচূর্ণকারী উমা হৈমবতীর রূপটি একালের বাংলায় কার্তিক শুক্লানবমীতে পূজিতা জগদ্ধাত্রীর অনুরূপ।

দেবী শৈলপুত্রীর ধ্যানমন্ত্রঃ

বন্দে বাঞ্ছিতলাভায় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
বৃষারূঢাং শূলধরাং শৈলপুত্রীং য়শস্বিনীম্ ॥
পূর্ণেন্দুনিভাঙ্গৌরীং মূলাধারস্থিতাং প্রথমদুর্গাং ত্রিনেত্রাম্ ।
পটাম্বরপরিধানাং রত্নকিরীটাং নানালঙ্কারভূষিতাম্ ॥
প্রফুল্লবদনাং পল্লবাধরাং কান্তকপোলাং তুঙ্গকুচাম্ ।
কমনীয়াং লাবণ্যস্নেহমুখীং ক্ষীণমধ্যাং নিতম্বনীম্ ॥

এই মন্ত্র জপ করে রাতে দেবী শৈলপুত্রীর আবাহন করুন। নবরাত্রী পুজা শেষ হলে প্রসাদ হিসাবে ঘৃতজাত খাদ্য গ্রহণ করুন। পারলে একজন কুমারী কন্যাকে নতুন বস্ত্র দান করে, ছানা মিষ্টান্নদি খাবার প্রদান করুন।

দেবী শৈলপুত্রীর মন্দির রয়েছে কাশীর (বারাণসী) আলাইপুরার মড়িঘাটের কাছে। বর্তমান মন্দিরটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের উপর নির্মিত। তবে মন্দির চত্বরের প্রাচীন কুয়োটি এখনও আছে। মূল মন্দিরটি ছোটো।

এই মন্দিরের গর্ভগৃহের পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে শৈলপুত্রীর কষ্টিপাথরের মূর্তিটি। সামনে কুণ্ডের মধ্যে কাশীখণ্ডস্থিত প্রাচীন শিবলিঙ্গ শৈলশ্বর। দেবীমূর্তি ও শিবলিঙ্গ উভয়েরই উচ্চতা এক হাত। শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রির প্রথম দিনে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। এই দিনটিই সাধকদের নবদুর্গা-আরাধনার প্রথম দিন; সাধকের মন এই দিনে মূলাধার চক্রে অবস্থান করে।

সোর্সঃ সনাতন ধর্ম প্রচার সংঘ – ফেসবুক পেজ ও দেবাশী’স কালেকশন

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.