যে কারণে আমরা গিরি গোবর্ধন পূজা করি! পর্ব – ৩

মনে মনে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কৃষ্ণ গোপেদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন তিনি কর্মমীমাংসা সমর্থনকারী একজন নাস্তিক । এই ধরনের দার্শনিকেরা পরমেশ্বর ভগবানের পরম আধিপত্য স্বীকার করেন না।

তারা যুক্তি প্রদান করেন যে, কেউ যখন ভালভাবে কর্ম করে তখন অবশ্যই তারা তার ফল লাভ করে। তাদের মত হচ্ছে যে, যদি ভগবান বলে কেউ থেকে থাকেন, যিনি মানুষের কর্ম অনুসারে ফল প্রদান করেন, তা হলে তাঁকে পূজা করার কোন কারণ নেই।

কেননা মানুষ যদি কর্ম না করে তা হলে তিনি কোন শুভ ফল প্রদান করতে পারেন না। তারা বলেন, মানুষের কতর্ব্য হচ্ছে দেবতা অথবা ভগবানের পূজা না করে নিষ্ঠা সহকারে কর্তব্যকর্ম করা এবং তা হলে তার শুভ ফল অবশ্যই লাভ হবে।

শ্রীকৃষ্ণ এই কর্মমীমাংসা দর্শনের তত্ত্ব অনুসারে তাঁর পিতার সংগে কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, “হে পিতঃ, আপনার কৃষিকার্যের সাফল্যের জন্য কোন দেবদেবতার পূজা করার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।

প্রতিটি জীবই তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে জন্মগ্রহণ করে এবং বর্তমান কর্মের ফল নিয়ে এই দেহ ত্যাগ করে। প্রতিটি জীবই তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন শরীর প্রাপ্ত হয় এবং এই জন্মের কর্ম অনুসারে তার পরবর্তী জন্ম লাভ করে।

বিভিন্ন ধরনের জাগতিক সুখ এবং দুঃখ , স্বাচ্ছন্দ্য এবং দুর্দশা, পূর্ব জীবনের অথবা বর্তমান জীবনের বিভিন্ন রকমের কর্মের ফল।

মহারাজ নন্দ এবং অন্যান্য গোপবৃদ্ধরা যুক্তি দেখালেন যে, আমরা বৈশ্য গোপ জাতি। কৃষি এবং গো-পালন আমাদের জীবিকা। গো-পালনের জন্য আমাদের ঘাসের প্রয়োজন। চাষের জন্য বৃষ্টি চাই। দেবতাদের সন্তুষ্ট না করে কেবলমাত্র কর্ম করা মাধ্যমে শুভ-ফল লাভ করা যায় না।

প্রকৃতপক্ষে সেই কথাটি ঠিকই যেমন, অনেক সময় দেখা যায় যে, খুব ভাল ডাক্তারের দ্বারা চিকিৎসা করা সত্ত্বেও এবং খুব ভাল ওষুধ খাওয়ানো সত্ব্বেও রোগীর মৃত্যু হয়। এর থেকে বোঝা যায় যো, খুব ভাল ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানো এবং ভাল ওষুধ খাওয়ানোটাই রোগমুক্ত হওয়ার কারণ নয়; পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছাই হচ্ছে মূল কারন ।

তেমনই, সন্তানের প্রতি মা-বাবার যত্ন নেওয়াটাই সন্তানের সুখ-স্বচ্ছন্দ্যের কারণ নয়। অনেক সময় দেখা গেছে যে, পিতা-মাতাদের যথেষ্ট তত্ত্বাবধান সত্ত্বে ও সন্তানেরা বিপথগামী হয়ে গেছে অথবা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। তাই জড় কারণগুলিই ফললাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়।

পরমেশ্বর ভগবানের অনুমোদন না থাকলে কোন কিছুই সফল হয় না। মহারাজ নন্দ তাই সেই নীতি সমর্থন করে বললেন যে, কৃষিকার্যে সুফল লাভ করতে হলে অবশ্যই বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে হবে।

এই যুক্তি খন্ডন করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে, দেবতারা মানুষকে তার কর্ম অনুসারে ফল দান করে থাকেন। কেউ যদি যথাযথভাবে তার কতর্ব্যকর্ম না করে, তা হলে দেবতারা তাকে কোন রকম সুফল দান করতে পারেন না; তাই দেবতারা মানুষের কতর্ব্যকর্মের অধীন। যে কোন মানুষকে তাদের ইচ্ছমতো ফলদান করতে দেবতারা পারেন না।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে পিতঃ, ইন্দ্রদেবতার পূজা করার কোন প্রয়োজন নেই। প্রত্যেককেই তার কর্ম অনুসারে ফল লাভ করতে হয়। আমরা দেখতে পাই যে, প্রকৃতপক্ষে সকলেই তাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কর্মে লিপ্ত হয়; এবং সেই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে মানুষই হোক্ বা দেবতাই হোক্, প্রত্যেকে যথাযথ ফল ভোগ করে থাকেন।

প্রতিটি জীবই উচ্চতর বা নিম্মতর দেহ প্রাপ্ত হয় এবং তাদের বিভিন্ন কর্ম অনুসারে, শত্রু, মিত্র বা নিরপেক্ষ ভাব অর্জন করে। তাই খুব সাবধানতার সঙ্গে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া উচিত এবং বিভিন্ন দেব-দেবীদের পূজা করে চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করা উচিত নয়। যথাযথভাবে কর্তব্যকর্ম সম্পদন করা হলে দেব-দেবীরা আপনা থেকেই সন্তুষ্ট হবেন।

তাই তাঁদের আলাদা করে পূজা করার কোন প্রয়োজন নেই। তাই, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে খুব ভালভাবে আমাদের কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করা। প্রকৃতপক্ষে, যথাযথভাবে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন না করে কেউই সুখী হতে পারে না, তাই যে যথাযথভাবে তা কতর্ব্য করে না, তাকে অসতী স্ত্রীলোকের সঙ্গে তূলনা করা হয়।

ব্রাহ্মনদের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে বেদ পাঠ করা, ক্ষত্রিয়ের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে প্রজাপালন করা, বৈশ্যের কতর্ব্যকর্ম হচ্ছে কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য, এবঙ শুদ্রের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের সেবা করা।

আমরা বৈশ্য, তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে কৃষিকার্য করা অথবা সেই কৃষিজাত দ্রব্য নিয়ে বাণিজ্য করা, গোরক্ষা কর, এবং টাকা ধার দেওয়া।

কৃষ্ণ বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত বলে নিজের পরিচয় দিলেন, কেননা নন্দ মহারাজ গো-পালন করতেন এবং কৃষ্ণ তাঁদের পরিচর্যা করতেন। বৈশ্যদের জন্য তিনি চার রকমের বৃত্তি প্রদর্শন করলেন যথা, কৃষি, বাণিজ্য, গোরক্ষা এবং টাকা ধার দেওয়া। যদি ও বৈশ্যরা এর যে কোন ও একটি বৃত্তি গ্রহণ করেত পারেন, কিন্তু ব্রজবাসীরা গোরক্ষা কার্যেই যুক্ত ছিলেন।

সোর্সঃ ইন্টারনেট এর বিভিন্ন মাধ্যম

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.