মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

কুর্মপুরাণে বৈশাখ শুক্লপক্ষের ‘মোহিনী’ একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন, হে জনার্দন! বৈশাখ শুক্লপক্ষীয়া একাদশীর কী নাম, কী ফল, কী বিধি, এ সকল কথা আমার নিকট বর্ণনা করুন। উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে ধর্মপুত্র! আপনি আমাকে যে প্রশ্ন করছেন, পূর্বে শ্রীরামচন্দ্রও বশিষ্ঠের কাছে এই একই প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে মুনিবর! আমি জনকনন্দিনী সীতার বিরহজনিত কারণে বহু দুঃখ পাচ্ছি। তাই একটি উত্তম ব্রতের কথা আমাকে বলুন। যার দ্বারা সর্ব পাপ ক্ষয় ও সর্ব দুঃখ বিনষ্ট হয়।

এই কথা শুনে বশিষ্ঠ বললেন, হে রামচন্দ্র! তুমি উত্তম প্রশ্ন করেছ। যদিও তোমার নাম গ্রহণেই মানুষ পবিত্র হয়ে থাকে। তবুও লোকের মঙ্গলের জন্য তোমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ ও পরম পবিত্র একটি ব্রতের কথা বলছি। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষীয়া একাদশী ‘মোহিনী’ নামে প্রসিদ্ধ। এই ব্রতের প্রভাবে মানুষের সকল পাপ, দুঃখ ও মোহজাল অচিরেই বিনষ্ট হয়। তাই মানুষের উচিত সকল পাপ ক্ষয়কারী ও সকল দুঃখ বিনাশী এই একাদশী ব্রত পালন করা। একাগ্রচিত্তে তার মহিমা তুমি শ্রবণ কর। এই কথা শ্রবণ মাত্রেই সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়।

বহু যুগ আগে পবিত্র সরস্বতী নদীর তীরে ভদ্রাবতী নামে সুন্দর নগরী ছিল। চন্দ্রবংশজাত ধৃতিমান নামে এক রাজা সেখানে রাজত্ব করতেন। সেই নগরীতেই ধনপাল নামে এক বৈশ্য বাস করতেন। তিনি ছিলেন পুণ্যকর্মা ও সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি। তিনি নলকূপ, জলাশয়, উদ্যান, মঠ ও গৃহ ইত্যাদি নির্মাণ করে দিতেন। তিনি ছিলেন বিষ্ণুভক্তি পরায়ণ ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ। সুমনা, দ্যুতিমান, মেধাবী, সুকৃতি ও ধৃষ্টবুদ্ধি নামে তার পাঁচ জন পুত্র ছিল। পঞ্চম পুত্র ধৃষ্টবুদ্ধি ছিলেন অতি অত্যাচারী। তিনি সর্বদা পাপকার্যে লিপ্ত থাকতেন। লাম্পট্য ও দ্যূতক্রীড়া প্রভৃতি পাপে তিনি অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। দেবতা,ব্রাহ্মণ ও পিতা-মাতার সেবায় তাঁর একেবারেই মতি ছিল না। তিনি অন্যায় কার্যে রত, দুষ্ট স্বভাব ও পিতৃধন ক্ষয়কারক ছিলেন। সব সময় তিনি অভক্ষ ভক্ষণ ও সুরাপানে মত্ত থাকতেন।

পিতা ধনপাল একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, ধৃষ্টবুদ্ধি এক বেশ্যার সঙ্গে নিঃসংকোচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর নির্লজ্জ পুত্রকে এই ভাবে দেখে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। এই কুস্বভাব দর্শনে ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজনও তাঁকে পরিত্যাগ করলেন। তিনি তখন নিজের অলংকার বিক্রি করে জীবন যাপন করতেন। কিছু দিন এই ভাবে চলার পর অর্থাভাব দেখা দিল। ধনহীন দেখে সেই বেশ্যারাও তাঁকে ত্যাগ করলেন।

অন্নবস্ত্রহীন ধৃষ্টবুদ্ধি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন। অবশেষে নিজের রাজ্যেই তিনি চুরি করতে লাগলেন। একদিন রাজপ্রহরী তাঁকে বন্দি করলেন। কিন্তু পিতার সম্মানার্থে তাঁকে মুক্ত করে দিলেন। এ ভাবে বারকয়েক তিনি ধরা পরলেন ও ছাড়া পেলেন। কিন্তু তবুও চুরি বন্ধ করলেন না। তখন রাজা তাঁকে কারাগারে বদ্ধ করে রাখলেন। বিচারে তিনি কষাঘাত ভোগ করলেন। কারাগারের পর অনন্য উপায় ধৃষ্টবুদ্ধি বনে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি পশুপাখি বধ করে তাদের মাংস ভক্ষণ করে অতি দুঃখে পাপময় জীবন যাপন করতে লাগলেন।

দুষ্কর্মের ফলে কেউ কখনও সুখী হতে পারে না। ধৃষ্টবুদ্ধিও তাই দুঃখ শোকে জর্জরিত হলেন। এ ভাবে অনেক দিন অতিবাহিত হল। কোনও পুণ্যফলে হঠাৎ একদিন তিনি কৌণ্ডিন্য মুনির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। বৈশাখ মাসে ঋষিবর গঙ্গাস্নান করে আশ্রমের দিকে ফিরছিলেন। শোকাকুল ধৃষ্টবুদ্ধি তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। ঘটনাক্রমে ঋষির বস্ত্র হতে এক বিন্দু জল তাঁর গায়ে পড়ল। সেই জলস্পর্শে তাঁর সমস্ত পাপ দূর হল। হঠাৎ তাঁর শুভবুদ্ধির উদয় হল।

ঋষির সামনে তিনি কৃতাঞ্জলিপুটে প্রার্থনা করে বললেন, হে ঋষিশ্রেষ্ঠ! যে পুণ্য প্রভাবে আমি এই ভীষণ দুঃখ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি, তা কৃপা করে আমাকে বলুন। ঋষিবর বললেন, বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষে মোহিনী নামে যে প্রসিদ্ধ একাদশী আছে, তুমি সেই ব্রত পালন কর। এই ব্রতের ফলে মানুষের বহু জন্মার্জিত পর্বত প্রমাণ পাপরাশিও ক্ষয় হয়ে থাকে। মহামুনি বশিষ্ঠ বললেন, কৌণ্ডিন্য ঋষির উপদেশে প্রসন্ন চিত্তে ধৃষ্টবুদ্ধি সেই ব্রত পালন করলেন।

হে মহারাজ রামচন্দ্র! এই ব্রত পালনে তিনি নিষ্পাপ হলেন। দিব্যদেহ লাভ করলেন। অবশেষে গরুড়ে আরোহণ করে সকল প্রকার উপদ্রবহীন বৈকুণ্ঠধামে গমন করলেন। হে রাজন! ত্রিলোকে মোহিনী ব্রত থেকে আর শ্রেষ্ঠ ব্রত নেই। যজ্ঞ, তীর্থস্থান, দান ইত্যাদি কোন পুণ্যকর্মই এই ব্রতের সমান নয়। এই ব্রত কথার শ্রবণ কীর্তনে সহস্র গোদানের ফল লাভ হয়।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.