পিতা এবং স্বামী, দুজনের কাছেই পরিত্যক্ত হয়েছিলেন দেবী মনসা

আজ যা লোকজ। কাল তা উচ্চবর্গীয়। যেমন মা মনসা। ছিলেন আদিবাসীদের পূজিতা। সেখান থেকে অন্ত্যজ শ্রেণীর আরাধ্যা। এখন তো হিন্দু তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে অন্যতমা। নদী নালা সাপখোপে ভরা পূর্ববঙ্গেই তাঁর পুজোর প্রচলন বেশি। তবে পুজো হয় বাংলার অন্য প্রান্তেও। এমনকী উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারতেও।

লোককথা থেকে পুরাণে উত্তরণ সামান্য বিষয় নয়। এই উন্নতির একটা ধাপ অবশ্যই চাঁদ বণিক। উচ্চবর্গের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে তাঁর হাতে পুজো পাওয়া দরকার ছিল মনসার। কোথাও তিনি নাগরাজ বাসুকির বোন এবং ঋষি জগত্‍কারুর স্ত্রী। আবার কোথাও তাঁর পিতা শিব। কোথাও তিনি কাশ্যপ ঋষির কন্যা।

পুরাণে বর্ণিত, কাশ্যপ ঋষির স্ত্রী কর্দু একটি নারীমূর্তি বানিয়েছিলেন। কোনওভাবে সেই মূর্তি মহাদেবের বীর্যের সংস্পর্শে এসেছিল। তার ফলে প্রাণসঞ্চার হয় ওই মূর্তিতে। সৃষ্টি হয় মনসার। কিন্তু তাঁকে কোনওদিন কন্যারূপে মানতে পারেননি শিবজায়া পার্বতী।

মনসা এক চোখে দৃষ্টিহীন। কারণ বিমাতা পার্বতী, চণ্ডী অবতারে মনসার এক চোখ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর নাম চ্যাংমুড়ি কানি। কিন্তু তিনি পদ্মে স্থিতা। ফলে আর এক নাম পদ্মালয়া। অনেক জায়গায় তিনি পূজিতা হন নিত্যা নামে।

মনসার অনেক রকম মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। সর্বাঙ্গে সাপ, মাথায় কাল কেউটের সাতটি ফণা থাকলেও তাঁর বাহন কিন্তু রাজহংস। কোথাও মা মনসার কোলে দেখা যায় পুত্র আস্তিককেও। অনেক জায়গায় তাঁর সঙ্গে পুজো পেয়ে থাকেন সহচরী ও মন্ত্রণাদাত্রী নেত্য ধোপানি।

মহাভারতে আছে মনসার বিবাহ বৃত্তান্ত। ঋষি জগত্‍কারু ছিলেন কঠোর ব্রহ্মচারী। স্থির করেছিলেন কোনওদিন বিয়ে করবেন না। কিন্তু জানতে পারলেন তাঁর পূর্বপুরুষরা মৃত্যুর পরে স্বর্গারোহণ করতে পারছেন না। কারণ উত্তরসূরীর হাতে তাঁদের শেষকৃত্য হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে বিয়ে করলেন মনসাকে। তাঁদের পুত্র আস্তিকের হাতে জল পেয়ে স্বর্গারোহণ করলেন পূর্বপুরুষরা। রাজা জন্মেয়জয় যখন পৃথিবী থেকে সর্পকুল ধ্বংস করতে চাইলেন তখন সাপদের রক্ষা করেছিলেন মনসাপুত্র আস্তিকই।

জীবনে সবকিছুই লড়াই করে জয় করতে হয়েছে মনসাকে। পিতা মহাদেব তাঁকে গ্রহণ করেননি। কিন্তু সমুদ্রমন্থনে বিষপানের পরে মহাদেবকে রক্ষা করেছিলেন কন্যা মনসাই। ফলে তাঁর আর এক নাম বিষহরি। আবার স্বামী জগতকারুও তাঁকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। কারণ স্ত্রী মনসা তাঁকে ভোরবেলায় ঘুম থেকে ডাকতে বিলম্ব করেছিলেন। পরে ক্রোধ প্রশমিত হলে স্ত্রী মনসার কাছে আবার ফিরে আসেন ঋষি।

বাংলার মঙ্গলকাব্যে আবার মা মনসার অন্য রূপ ধরা পড়েছে। মধ্যযুগীয় এই সাহিত্যে তিনি যেভাবে হোক ,মর্ত্যে নিজের প্রতিপত্তি বিস্তার করতে বদ্ধ পরিকর। বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য এবং বিপ্রদাস পিপিলাই-এর মনসা বিজয় কাব্য অমর করেছে চাঁদ সওদাগর-মনসার দ্বন্দ্ব। যা একদিকে শৈব বনাম লোকজ উপদেবীর দ্বন্দ্ব। আবার অন্যদিকে মানুষ ও দেবতার দ্বন্দ্ব। যেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে মর্ত্যের মানুষের সাহায্য চাইছেন স্বর্গের এক দেবী।

একে একে চাঁদ বণিকের সপ্তডিঙা ও ছয় পুত্রকে কেড়ে নেন দেবী মনসা। মনসার ইচ্ছায় ইন্দ্রের সভার নর্তক অনিরুদ্ধ ও নর্তকী ঊষা জন্ম নেন লখিন্দর-বেহুলা হয়ে। চাঁদ সদাগরের কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন লখিন্দর। লখিন্দর-বেহুলার বাসরে লোহার ঘরের ছিদ্র দিয়ে সাপ ঢুকিয়ে দেন মনসা। সর্পাঘাতে মৃত্যু হয় লখিন্দরের। অতঃপর ভেলায় ভেসে দেবীর কাছ থেকে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনেন বেহুলা। সঙ্গে ফিরিয়ে আনেন চাঁদ বণিকের মৃত পুত্রদের এবং হারিয়ে যাওয়া সব ধনসম্পদ।

বিনিময়ে ছিল একটিমাত্র শর্ত। চাঁদ বণিক যেন মনসার পুজো করেন। তিনি তা করেছিলেন অবশ্য। কিন্তু দেবীর দিকে পিছন ফিরে বাঁ হাতে ফুল ছুড়ে দিয়েছিলেন। মঙ্গলকাব্যের সেই অমোঘ পঙক্তি, ‘ যেই হাতে পূজি আমি দেব শূলপাণি, সেই হাতে পূজিব কি চ্যাংমুড়ি কানি ‘। তাতেই সন্তুষ্ট মা মনসা।

মূলত মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যই গ্রামাবাংলায় জনপ্রিয় করে তোলে মনসা ও অষ্টনাগ পুজোকে। অনেক জায়গায় চল হল, কোনও প্রতিমা ছাড়া গাছের ডাল পুজো করা। তবে পুজো করা হয় প্রতিমা ও পটচিত্রও। প্রচলিত বিশ্বাস হল, বর্ষায় সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা করবেন দেবী। এছাড়া বাঁচাবেন জলবসন্ত, গুটিবসন্তর মতো রোগ থেকে। বিবাহ ও উর্বরতার দেবী হিসেবেও পূজিতা হন তিনি।

রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, বণিক সম্প্রদায়, বিশেষত সাহা পদবীধারীদের মধ্যেও মা মনসার পুজো বহুল প্রচলিত। কারণ চাঁদ সদাগর নিজে ছিলেন বণিক। সেইসঙ্গে বেহুলা ছিলেন সাহা পরিবারের মেয়ে। ভক্তদের বিশ্বাস, যাঁরা তাঁর পুজো করেন, তাঁদের প্রতি মা মনসা স্নেহময়ী। কিন্তু যাঁরা পুজো করেন না, তাঁদের তিনি ছারখার করে দেন।

সূত্রঃ ডেইলিহান্ট

 

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.