জগদ্ধাত্রী পূজার কিছু ইতিহাস ও তথ্যাবলী যা আপনি জানেন না…

জগদ্ধাত্রী দুর্গা- ‘জয় সর্বগত দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোহস্তুতে’! জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ “জগৎ+ধাত্রী। জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)।” ব্যাপ্ত অর্থে দুর্গা, কালী সহ অন্যান্য শক্তিদেবীগণও জগদ্ধাত্রী। জগদ্ধাত্রীপূজা হিন্দুদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তিনিই জগৎ সভ্যতার পালিকা শক্তি। তিনি দেবী দুর্গারই আর এক রূপ। তাই জগদ্ধাত্রীর প্রণামমন্ত্রে তাঁকে ‘দুর্গা’ বলে স্তুতি করা হয়েছে। তবে শাস্ত্রনির্দিষ্ট জগদ্ধাত্রী রূপের নামকরণের পশ্চাতে রয়েছে সূক্ষ্মতর ধর্মীয় দর্শন। জগদ্ধাত্রী বা জগদ্ধাত্রী দুর্গা হচ্ছেন দেবী দুর্গার রূপভেদ। একই দেবীর দুই রূপ। এক জন দুর্গা, অন্য জন জগদ্ধাত্রী। উপনিষদে এঁর নাম উমা হৈমবতী । বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থেও এঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। জগদ্ধাত্রী আরাধনা বিশেষত বঙ্গদেশে প্রচলিত। আবার পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চন্দননগর,গুপ্তিপাড়া ও নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী উৎসব জগদ্বিখ্যাত। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর।

স্বামী প্রমেয়ানন্দের মতে, “ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি জগদ্ধাত্রী। সগুণ ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশরূপ তিনগুণের যুগপৎ প্রকাশ যেমন কালীরূপের বৈশিষ্ট্য, তাঁর ধারণী ও পোষণী গুণের যুগপৎ প্রকাশও জগদ্ধাত্রীরূপের বৈশিষ্ট্য।… ধা ধাতুর অর্থ ধারণ বা পোষণ। ভগবতী নিখিল বিশ্বকে বক্ষে ধারণ করে পরিপালন করেন বলে মুনিগণ কর্তৃক তিনি ত্রৈলোক্যজননী নামে অভিহিত।… নিয়ত-পরিবর্তনশীল এই জগতের পেছনে রয়েছে তার রক্ষণ ও পোষণের জন্য অচিন্তনীয়া মহাশক্তির এক অদ্ভুত খেলা। সতত পরিবর্তনশীল জগৎ সেই মহাশক্তির দ্বারা বিধৃত – যিনি নিত্যা, শাশ্বতী ও অপরিবর্তনীয়া। দেবী জগদ্ধাত্রীই সেই ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি।”

তিনি সিংহবাহিনী, তবে দুর্গার মতো জগদ্ধাত্রী দশভূজা নন চতুর্ভুজা, নানা আভরণভূষিতা, অরুণকিরণবৎ বর্ণযুক্তা এবং সর্পরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী। তাঁর বাম দিকের দুহাতে থাকে শঙ্খ ও ধনু এবং ডান দিকের দুহাতে থাকে চক্র ও পঞ্চবাণ। রক্তবর্ণের বস্ত্র তাঁর পরিধানে। তিনি সত্ত্বগুণের প্রতীক, তাই প্রথম সূর্যের মতো তাঁর গায়ের রং। অর্থাৎ, দেবীর গাত্রবর্ণটি কমলা। কিন্তু, দুর্গার সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপন করে বর্তমানে তাঁর মূর্তিটি নির্মাণ করা হয় তা হল তপ্তকাঞ্চনবর্ণ বা কাঁচা সোনার রঙে। কমলা রঙের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা বর্তমানে এই বঙ্গে দুর্লভ। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর। নারদাদি মুনিগণ তাঁর নিত্যসেবা করে থাকেন- “সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্/চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্/শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্/চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে/রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্/নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।”

জগদ্ধাত্রী পূজার নিয়মটি একটু স্বতন্ত্র। দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজার ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। কাত্যায়নীতন্ত্র–এ কার্তিকী শুক্লা নবমীতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আবির্ভূত হওয়ার কথা আছে। জগদ্ধাত্রী পূজা তান্ত্রিক পূজা। দুটি প্রথায় এই পূজা হয়ে থাকে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী – এই তিন দিন জগদ্ধাত্রীর পূজা হয়ে থাকে।। কোথাও কোথাও প্রথম বা দ্বিতীয় পূজার পর কুমারী পূজারও আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার ন্যায় জগদ্ধাত্রী পূজাতেও বিসর্জনকৃত্য বিজয়াকৃত্য নামে পরিচিত। এমনকি পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্রও দুর্গাপূজার অনুরূপ।

উপনিষদে দেবী জগদ্ধাত্রীঃ

কেন উপনিষদঃ

কেন উপনিষদে উল্লিখিত একটি উপাখ্যান অনুসারে: জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের তিন নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে- “জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে/জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে।” আবার কিছু কিছু পুরাণ বলছে, মহিষাসুর বধের পর দেবতাদের উল্লাসের কথা। তাঁরা ভেবেছিলেন, দুর্গা যেহেতু তাঁদেরই সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ, তাই অসুর বধ হয়েছে তাঁদেরই যুগ্ম শক্তিতে। ব্রহ্মার বরের সম্মানরক্ষা করতে কেবল ওই নারীদেহটির আবশ্যিকতা। তখন ব্রহ্ম যক্ষের বেশ ধারণ করে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। তাঁদের ওই গর্ব দেখে পরমেশ্বরী দেবী একটি তৃণখণ্ড অলক্ষ থেকে নিক্ষেপ করলেন দেবতাদের দিকে। পরীক্ষা করতে চাইলেন তাঁদের শক্তি। ইন্দ্র বজ্রদ্বারা সেই তৃণটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেন। অগ্নি সেই তৃণ দহন করতে পারলেন না, বায়ু অসমর্থ হলেন তা উড়িয়ে নিয়ে যেতে। বরুণের শক্তি সেই তৃণটুকুর একটি অংশও জলস্রোতে প্লাবিত করতে পারল না। দেবতাদের এই দুরবস্থা দেখে তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হল এক পরমাসুন্দরী সালঙ্কারা চতুর্ভুজা মূর্তি। তিনিই জগদ্ধাত্রী। জগদ্ধাত্রী এভাবে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের জ্ঞানচক্ষুটি উন্মীলিত করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, তিনিই এই জগতের ধারিণী শক্তি।

কাত্যায়নী তন্ত্রঃ

উপনিষদে উমার রূপবর্ণনা নেই। কেবলমাত্র তাকে হৈমবতী অর্থাৎ স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা বলা হয়েছে। তবে এই হৈমবতী উমাই যে দেবী জগদ্ধাত্রী সে প্রত্যয় জন্মে কাত্যায়ণী তন্ত্রের ৭৬ পটলে (অধ্যায়) উল্লিখিত একটি কাহিনি থেকে। এই কাহিনি অনুসারে : একদা ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র – এই চার দেবতা অহংকার-প্রমত্ত হয়ে নিজেদের ঈশ্বর মনে করতে শুরু করলেন। তারা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই – মহাশক্তির শক্তিতেই তারা বলীয়ান। দেবগণের এই ভ্রান্তি অপনয়নের জন্য দেবী জগদ্ধাত্রী কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। এর পরের কাহিনি কেন উপনিষদে বর্ণিত তৃণখণ্ডের কাহিনির অনুরূপ। দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে অসমর্থ হলেন। দেবগণ নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন। তখন দেবী তার তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন। এই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ও দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এক মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তি। সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে দেবী দেবগণকে এই মূর্তি দেখালেন; দেবগণও তার স্তবে প্রবুদ্ধ হলেন।

মূর্তিতত্ত্বঃ

জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্রে দেবীর যে রূপকল্পনা করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:

সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।
চতুর্ভূজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্।
চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে।।
রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্।
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।
ত্রিবলীবলয়োপেতনাভিনালমৃণালিনীম্।
রত্নদ্বীপে মহাদ্বীপে সিংহাসনসমন্বিতে।
প্রফুল্লকমলারূঢ়াং ধ্যায়েত্তাং ভবগেহিনীম্।।
 

– মহাদেবী জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলংকারে ভূষিতা ও নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী। দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু; দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র ও পঞ্চবাণ। রক্তবস্ত্রপরিহিতা সেই ভবসুন্দরী প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা। নারদাদি মুনিগণ তার নিত্যসেবা করে থাকেন। তার ত্রিবলিবলয়সমন্বিত নাভিমণ্ডল মৃণালবিশিষ্ট পদ্মের ন্যায়। সেই শিবপত্নী রত্নদ্বীপরূপ উচ্চ বেদিকায় স্থিত সিংহাসনে প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর উপবিষ্টা। নাগযজ্ঞোপবীতিনী জগদ্ধাত্রী; নাগরূপ যজ্ঞোপবীত মহাযোগিনী ব্রহ্মময়ী জগদ্ধাত্রীর প্রতীক

জগদ্ধাত্রী দেবীর মূর্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন, “অর্ক বা সূর্যই বিশ্বের পোষণকর্তা। পৃথিব্যাদি আবর্তনশীল গ্রহ-উপগ্রহদিগকে সূর্যই নিজের দিকে আকর্ষণ করে রেখেছেন। দেবী জগদ্ধাত্রীর মধ্যেও ধারণী ও পোষণী শক্তির পরিচয় বিদ্যমান। তাই তাঁকে বলা হয়েছে বালার্কসদৃশীতনু। একই কারণে জগৎপালক বিষ্ণুর শঙ্খ-চক্র-শার্ঙ্গধনু-আদি আয়ুধ দেবীর শ্রীকরে।… দেবীর রক্তবস্ত্র ও রক্তবর্ণের মধ্যে, দেবীর সিংহাসনস্থ রক্তকমলে সেই রজোগুণেরই ছড়াছড়ি। রজোদীপ্ত বলেই জগদ্ধাত্রী মহাশক্তিময়ী। তাঁর অস্ত্রশস্ত্র, তাঁর বাহন – সকলই তাঁর শক্তিমত্তার ভাবটি আমাদের অন্তরে উদ্দীপ্ত করে দেয়। তবে দেবীর এই বীর্য সংহারের নয়। পরন্তু সমগ্র বিশ্বকে মহাসর্বনাশ থেকে রক্ষাপূর্বক তাকে আত্মসত্তায় – ঋতে ও সত্যে সুস্থির করে রাখবার জন্য। … নাগ বা সর্প যোগের পরিচায়ক। উপবীত ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতীক। দেবী জগদ্ধাত্রী ব্রহ্মময়ী; তিনি পরমা যোগিনী। মহাযোগবলেই ব্রহ্মময়ী ধরে আছেন এই নিখিল বিশ্বসংসারকে। এই জগদ্ধারণই জগদ্ধাত্রীর পরম তপস্যা – তাঁর নিত্য লীলা, তাঁর নিত্য খেলা। জননীরূপে তিনিই বিশ্বপ্রসূতি, আবার ধাত্রীরূপে তিনিই বিশ্বধাত্রী।” আমাদের খুব প্রিয় মহিষাসুর মর্দিনী আকাশবাণীতে প্রচারিত হওয়ার সুরুতে ……” সিনহস্থা শশিশেখরা……… চতুর ভুজাই…………” এই স্তব মন্ত্র শুনলে দেখা যাবে যে এটিও দুর্গার জগদ্ধাত্রী রুপেরি বর্ণনা …

করীন্দ্রাসুরনিসূদিনীঃ

জগদ্ধাত্রী যে দুর্গারই বিকল্প রূপ, তার প্রথম সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচণ্ডীতে। সেখানে বলা আছে, যুদ্ধের সময় মত্ত মহিষাসুর নানা মায়ারূপ ধরে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন দেবীকে। একবার সেই প্রচেষ্টায় মহিষাসুর ধারণ করেন হস্তীরূপ। সেই হস্তী দেবীকে বধের চেষ্টা করলে দুর্গা ধারণ করেন এক চতুর্ভুজা মূর্তি। চক্রদ্বারা তিনি ছেদন করেন হাতির শুঁড়টি। সেই রূপটিই জগদ্ধাত্রীর। সেই জন্যই ধ্যানমন্ত্রে কোথাও উল্লেখ না থাকলেও মূর্তিতত্ত্বে আমরা দেখছি, জগদ্ধাত্রী বাহন সিংহ এক হস্তীর মৃত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে। কখনও বা সেই সিংহ খেলা করে হস্তীর কাটা মাথা নিয়ে। সংস্কৃতে হাতির একটি নাম করী, সেই অনুসারে অসুরটির নাম করীন্দ্রাসুর। তাকে বধ করেন বলে জগদ্ধাত্রীর অপর নাম করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায়, “মন করীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।… সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতীকে জব্দ করে রেখেছে।” স্বামী নির্মলানন্দের মতে, “যে-কোনো সাধনায় মনকে সংযত করে বশে আনা সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। আমাদের মন মত্ত করী, মন-করীকে বশ করতে পারলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ অবশ্যম্ভাবী।… মত্ত মন-করীকে বশ করে সাধক-হৃদয়ে জগদ্ধাত্রীর প্রতিষ্ঠায়ই জগদ্ধাত্রী-সাধনার সার্থকতা, পূজার পরিসমাপ্তি।” করীন্দ্রাসুর এর বর্ণনা ওই নামে না থাকলেও চণ্ডীতে উল্লেখ আছে মহিষাসুর এক মহাহস্তি রুপে দেবীকে আক্রমণ করে এবং দেবী তার মুণ্ড চ্ছেদ করেন…… তখন সে এক পুরুশ রুপে অবতীর্ণ হয়ে দেবীকে যুদ্ধে আওভান করলে ……… মা তাকে তিরে বিদ্ধ করেন……… এই তির ধনুক দেবির এই মূর্তিতে বর্তমান।।

কার্তিকে শুক্লপক্ষেঽহনি ভৌমবারে জগৎপ্রসূঃ।
সর্বদেবহিতার্থায় দুর্বৃত্তশমনায় চ।।
আবিরাসীৎ জগচ্ছান্ত্যৈ যুগাদৌ পরমেশ্বরী।।
-দেবগণের হিত, দুর্বত্তের প্রশমন এবং জগতের শান্তিবিধানের জন্য যুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে পরমেশ্বরী (জগদ্ধাত্রী) আবির্ভূতা হলেন।
কালবিবেক গ্রন্থে পূজার বিধান প্রসঙ্গে শূলপাণি লিখছেন:
কার্তিকোঽমলপক্ষস্য ত্রেতাদৌ নবমেঽহনি।
পূজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং সিংহপৃষ্ঠে নিষেদূষীম্।।
-ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে সিংহপৃষ্ঠে সমাসীনা দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা করিবে।

ইতিহাসঃ

জগদ্ধাত্রীর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় মায়াতন্ত্রে, বৃহস্পতি রায়মুকুটের স্মৃতিরত্নহারে (১৫-১৬শ শতক), কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে (১৬শ শতক) এবং শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণির কৃত্যতত্ত্বার্ণবে। আবার কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতোম প্যাঁচার নকশায় লিখছেন, সেই সময়ের বাবু কলকাতা দুর্গার মতো জগদ্ধাত্রী মূর্তিতেও স্থান দিয়েছে লক্ষ্মী-সরস্বতীকে- “বারোইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু– ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মূর্তি– সিঙ্গির গায়ে রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া। ঠাকরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আদল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে জোড়হাত ক’রে স্তব কচ্চেন।”

জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, দুর্গা বা কালীপূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ঘটে। অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন। পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয়। তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হত। জগদ্ধাত্রী পূজা প্রথমে কট্টর ভাবেই প্রচলিত ছিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে। দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক যা ব্রাহ্মণদের একটি বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করা হয়। দেবীর গলায় থাকে নাগযজ্ঞোপবীত যা স্পষ্টভাবেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পরিচায়ক। আবার, মন্ত্রে এই দেবীকে সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে বিকল্প এবং শ্রেণিবিভাগ। সত্ত্বগুণধারিণী জগদ্ধাত্রীর পূজা করবেন ব্রাহ্ণরা, রজোগুণধারিণী দুর্গার পূজা ক্ষত্রিয়রা এবং তমোগুণধারিণী কালীর পূজা অন্যরা। পরে ব্রাহ্মণদের এই জগদ্ধাত্রী আরাধনার সূত্রটি গ্রহণ করলেন বণিকশ্রেণি। দুর্গাপূজায় তাঁদের অধিকার নেই, কালীপূজা তন্ত্রসম্মত বলে সবার সামর্থ্য নয়, অতএব রইলেন কেবল এই জগদ্ধাত্রী দুর্গাই!

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজাঃ

প্রচলিত আছে বঙ্গদেশে অন্নপূর্ণা আর জগদ্ধাত্রী পূজা নাকি নদিয়াধিপতি অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে শুরু হয় বা তাঁর রাজত্বকালেই এর ব্যাপক প্রচলন হয়। অন্নদাপুজোর ব্যাপারটা নয় ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্য থেকে অনুমান করা গেল, কিন্তু জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়টা কখন? অনেকে বলেন, সেটা নবাব আলিবর্দির আমল কিন্তু সেটা কিছুতেই সম্ভব না। বরং কিছুটা সারবত্তা আছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা স্বনামধন্য দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত’এর অনুমানে কিংবদন্তী অনুসারে নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালে মহাবদজঙ্গ রাজার নিকট থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। নজরানা দিতে অপারগ হলে তিনি রাজাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। মুক্তির পর নদীপথে কৃষ্ণনগরে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘাটে বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে তিনি বুঝতে পারেন সেই বছর দুর্গাপূজার কাল উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপূজার আয়োজন করতে না পেরে রাজা অত্যন্ত দুঃখিত হন। সেই রাতে দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী দুর্গার পূজা করার আদেশ দেন। অনেকে বলে থাকেন মিরকাশিমের মুঙ্গের কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুক্তিলাভের জন্য ভান করে রাজা নাকি এই দেবীর পূজা করতে বসেছিলেন। আরও এক মতানুসারে, রাজা নাকি দেবীর স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত হন মিরকাশিমের হাজত থেকে মুক্ত হয়ে নৌকাযোগে ফেরার পথে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা ১৭৬৬ সালে। কেউ কেউ আবার কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক মনে করেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দরজা জগদ্ধাত্রী পূজার সময় আজও খোলা থাকে। পূজা পুরনো প্রথা মেনে হয় শুধুমাত্র নবমী তিথিতে।

এই মুক্তি পাওয়ার গল্পে দেবীমহিমার কতটা হাত আছে, তা ভগবান জানেন। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনাশ্রিত উপন্যাস লেখার জন্য ওই সময়ের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে ইঙ্গিত পেয়েছি, সময়কালটা ১৭৬৩ সাল। সেই সময়ের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটার্ট, যিনি প্রায় নিজ দায়িত্বে মিরজাফরকে সরিয়ে তখ্‌তে বসিয়েছিলেন মিরকাশিমকে। কিন্তু নবাব হওয়ার পর নানা কারণে মিরকাশিম বেঁকে বসলেন আর পলাশির চক্রান্তের শাস্তি দেওয়ার জন্য একের পর বন্দি ও খুন করতে লাগলেন ইংরেজ ঘনিষ্ঠ ষড়যন্ত্রী রাজন্যদের। নবাবের প্রতিশোধ প্রবণতায় ছাড় পেলেন না তৎকালীন জগৎ শেঠ মহাতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপচন্দ, ঢাকার নায়েব রাজবল্লভ সেন প্রমুখ। যুবরাজ শিবচন্দ্র সহ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটক করা হল বিহারের মুঙ্গেরের কয়েদখানায়। এ দিকে ২ অগস্ট গিরিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে হেরে মিরকাশিমের সব রাগ গিয়ে পড়ল তাঁর আর্মেনিয়ান সেনাপতি গর্গিনখাঁয়ের ( বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস চন্দ্রশেখরের চরিত্র গুরগনখাঁ, আর্মেনিয়ান নথি ঘাঁটতে গিয়ে পেয়েছি আসল নাম খোয়াজা পেট্রাস গ্রেগরি) উপর। গর্গিনখাঁকে হত্যা করানোর পর হননের নেশায় পেয়ে বসল নবাবকে, আরও কয়েকজনকে প্রাণদণ্ড দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হল নদিয়ারাজেরও। কিন্তু সেই ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও রাজা কী করে প্রাণে বেঁচে ফিরলেন, সেটা রীতিমত রহস্যময় ব্যাপার।

অনুমান সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাসের পাঁচ কি ছয় তারিখ, উদয়নালার যুদ্ধে ইংরেজবাহিনীর কাছে আবার হেরে মিরকাশিম রোহতাসগড় দুর্গের দিকে পালালে কিছু সপ্তাহের ভিতর ইংরেজবাহিনী মুঙ্গের দুর্গের দখল নেয় এবং কৃষ্ণচন্দ্র ও শিবচন্দ্রকে উদ্ধার করে। পালানোর আগে অবশ্য মিরকাশিমের আদেশানুসারে জগঠ শেঠ মহাতব রায়, স্বরূপচাঁদ, রাজবল্লভ সেন প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের গঙ্গার জলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয় (নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনি)। কিন্তু ভাগ্য অত্যাধিক সুপ্রসন্ন থাকায় সে যাত্রায় কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণরক্ষা হয়। ধার্মিক রাজা নিশ্চয়ই এ সবের পিছনে দেবীর অলক্ষ্য হাত দেখতে পান আর সেই কৃতজ্ঞতার বশেই তিনি আয়োজন করে বসেন দেবী জগদ্ধাত্রী আরাধনার।

তবে লোকশ্রুতিতে গল্পটি আর রাজার মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার সময়কাল কিঞ্চিত আলাদা। সুধীর চক্রবর্তী তাঁর ‘উৎসবে মেলায় ইতিহাসে’ নদিয়ার হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো সেই বিশ্বাসকে ভাষা দিয়েছেন এই ভাবে যে, “যখন কারাগার থেকে মুক্ত হলেন রাজা তখন আশ্বিন মাস। এখানে দুর্গাপূজা। বিজয়াদশমীর বিকালে পৌঁছলেন নদিয়ার রুকুনপুর ঘাটে। শ্রান্ত আশাহত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ঢলে পড়লেন ঘুমে। তারপরেই সেই স্বপ্ন। তবে স্বপ্নের সেই দেবীমূর্তি দুর্গা নন, অথচ ত্রিনয়নী চারহাত রক্তাম্বরধারিণী। সাদা নরসিংহে যোদ্ধার মতো বসে আছেন। দুই হাতে শঙ্খচক্র আর দুই হাতে ধনুর্বাণ। স্বপ্নে দেবীর প্রত্যাদেশ হল: সামনের শুল্কা নবমীতে একইদিনে সপ্তমী-অষ্টমী-নবমীপূজা করলেই দুর্গাপূজার অনুকল্প হবে। রাজা তাই করলেন। সেই থেকে কৃষ্ণনগরে চালু হল জগদ্ধাত্রীর পূজা।”

কিন্তু কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী তাঁর ‘নবদ্বীপ মহিমা’য় স্পষ্টই বলেছেন, কৃষ্ণচন্দ্রের পপৌত্র মহারাজা গিরিশচন্দ্রের (রাজত্বকাল ১৮০২-১৮৪১) পূর্বে আমাদের বঙ্গদেশে জগদ্ধাত্রীপুজার প্রচলন ছিল না। “উক্ত মহারাজের যত্নে তন্ত্র হইতে ওই মূর্তি প্রকাশিত হয়। শান্তিপুরের নিকটবর্তী ব্রহ্মশাসন গ্রামনিবাসী চন্দ্রচূড় ন্যায়পঞ্চানন নামক জনৈক তন্ত্রশাস্ত্র বিশারদ পণ্ডিতকর্তৃক এই মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। পরে নবদ্বীপের পণ্ডিতগণের অনুমোদিত হইলে ওই মূর্তির পূজা আরম্ভ হয় ।” গিরীশচন্দ্র নিজে যেহেতু ছিলেন তন্ত্রচর্চাকারী রাজা আর দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপ বিবর্তনে যেহেতু তন্ত্রের প্রভাব স্পষ্ট (জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায় “মায়াতন্ত্র” ও কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ‘তন্ত্রসার’, এমনকি বেশ কিছু বৌদ্ধতন্ত্রেও) তাই কান্তিচন্দ্র রাঢ়ীর দাবিকে কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনও হতে পারে, জগদ্ধাত্রী পুজো সর্বজনীন অর্থে পূর্বপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে শুরু হলেও তার জাঁকজমক ও শ্রীবৃদ্ধি হয় রাজা গিরীশের আমলে।

আসলে নদিয়ার আঠারো শতকের ইতিহাসে কৃষ্ণচন্দ্র এমনই এক সর্বগ্রাসী চরিত্র যে, সেই সময় উল্লেখযোগ্য যাই ঘটেছে প্রায় সব কিছুর সঙ্গে নাম জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর নাম। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা ভুলে গিয়েছি হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সাকার আরাধনার আরও বড় পৃষ্ঠপোষক মহারাজা গিরীশকে। গিরীশচন্দ্রও কিন্তু শিল্পসংস্কৃতির কম বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। তাঁর আমলেই দিল্লির বিখ্যাত কালোয়াত কায়েম খাঁ আর তাঁর তিনপুত্র মিয়া খাঁ, হম্মু খাঁ ও দেলাওর খাঁ কৃষ্ণনগর রাজদরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এবং তাঁর সভাতেই রাজপরিকর হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন রসরাজ কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ি।

১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন। বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত এই পূজা শুরু হয়েছিল ঘটে ও পটে। প্রথম দিকে স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে এই পূজার আয়োজন করতেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘটপটের পরিবর্তে প্রতিমায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল প্রায় সাড়ে সাতশো ভরি সোনায় গয়নায় দেবীপ্রতিমার অলংকারসজ্জা। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের মতে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা; তার নিকট সকল মনোষ্কামনাই পূর্ণ হয়।

এছাড়া কৃষ্ণনগরের উল্লেখযোগ্য বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি হল প্রীতি সম্মেলনী, বালকেশ্বরী, মালোপাড়া, হাতারপাড়া, উকিলপাড়া, ষষ্ঠীতলা, বউবাজার, নেদেরপাড়া, বাঘাডাঙা, পাত্রমার্কেট, কৃষ্ণনগর স্টেশন চত্বর, বেজিখালি, চকেরপাড়া, বাগদিপাড়া, মাঝেরপাড়া, ঘূর্ণি, হরিজনপল্লি, তাঁতিপাড়া, কালীনগর ইত্যাদি।

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজাঃ

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। জানা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রনারায়ণ ছিলেন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান। প্রায় আড়াইশো বছর আগে, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। লক্ষ্মীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই পূজার সূচনা। এই পূজা চন্দননগরে আদি পূজা নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প হয়। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। শোনা যায়, বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা। লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়েপট্টির জগদ্ধাত্রী পূজা চন্দননগরে দ্বিতীয় প্রাচীনতম পূজা। ১৭৬৮ সালে চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (মতান্তরে শশধর) রীতিমতো চাঁদা তুলে এই পূজা প্রবর্তন করেন। এই অঞ্চলের অপর দুটি পূজা হল লক্ষ্মীগঞ্জ চৌমাথা (স্থাপিত ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) ও লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের (স্থাপিত ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ) পূজা। উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি, কাপড়েপট্টি, চৌমাথা ও বাজার – এই চার পূজাতেই সিংহের রং সাদা। উত্তর চন্দননগরের অন্যান্য বড়ো জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি হল চন্দননগর বাগবাজার (স্থাপিত ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ), খলিসানী কলপুকুরধার, বউবাজার শীতলাতলা, খলিসানী বউবাজার, বাগবাজার চৌমাথা, বিদ্যালঙ্কার, পালপাড়া, বিবিরহাট উত্তরাঞ্চল, বিবিরহাট চড়কতলা তেমাথা, হরিদ্রাডাঙা, হেলাপুকুরধার, নাড়ুয়া, কাঁটাপুকুর, কাঁটাপুকুর চৌমাথা, বোড়ো কালীতলা, বোড়ো পঞ্চাননতলা, বোড়ো চাঁপাতলা, বোড়ো দিঘির ধার, বোড়ো তালডাঙা ইত্যাদি।

দক্ষিণ চন্দননগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পূজাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানকুণ্ডু সার্বজনীন, মানকুণ্ডু নতুনপাড়া, নিয়োগী বাগান, সার্কাস মাঠ, তেমাথা, অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাব, মরান রোড, গোন্দলপাড়া মনসাতলা, সাতঘাটা, গোন্দলপাড়া চারমন্দিরতলা, বেশোহাটা, লিচুতলা হাজিনগর, হাটখোলা দৈবকপাড়া, মনসাতলা, ভুবনেশ্বরীতলা, নোনাটোলা, বড়বাজার, পাদ্রিপাড়া, লালবাগান, ড্যুপ্লেক্সপট্টি, শ্রমিকপল্লি, সুভাষ জাগরণ সংঘ তেমাথা, অরবিন্দ সংঘ, বারাসত দক্ষিণ, বারাসত গেট। দক্ষিণ চন্দননগরের হালদারপাড়ার আদিপুজো অশ্বত্থতলার বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত। এই পূজা লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি ও কাপড়েপট্টির পূজার সমসাময়িক বলে মনে করা হয়। চন্দননগর কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পূজা কমিটির অনুমোদিত তিনশের অধিক পূজা হয় । চন্দননগরের আলোকসজ্জা , দেবীমূর্তি ও শোভাযাত্রা বিশ্বখ্যাত।

জয়রামবাটীর জগদ্ধাত্রী পূজাঃ

বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সহধর্মিণী সারদা দেবীর জন্মভিটা র জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। পূজা উপলক্ষে জয়রামবাটীতে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে এই পূজার আয়োজন করে রামকৃষ্ণ মিশন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে (১২৮৪ বঙ্গাব্দ) সারদা দেবীর পিতৃগৃহে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেছিলেন তার জননী শ্যামাসুন্দরী দেবী। কিংবদন্তি অনুসারে, প্রতি বছর শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রতিবেশী নব মুখুয্যের বাড়ির কালীপূজা উপলক্ষে নৈবেদ্যের চাল পাঠাতেন। ওইবছর কোনো বিবাদের কারণে নব মুখুজ্যে চাল নিতে অস্বীকার করেন। নৈবেদ্যদানে অসমর্থ হয়ে শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত মর্মাহত হন। সেই রাতেই তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীকে স্বপ্নে দেখেন এবং তার স্বপ্নাদেশে ওই চালে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন। প্রথম বছর বিসর্জনের দিন বৃহস্পতিবার ছিল। তাই সারদা দেবী লক্ষ্মীবারে বিসর্জনে আপত্তি করেছিলেন। পরদিন সংক্রান্তি ও তার পরদিন মাস পয়লা থাকায় ওই দুই দিনও বিসর্জন দেওয়া যায়নি। বিসর্জন হয় চতুর্থ দিনে। আরও কথিত আছে যে, পরের বছর সারদা দেবী জগদ্ধাত্রী পূজা বন্ধ করে দিতে চাইলে দেবী জগদ্ধাত্রী তাকে স্বপ্নাদেশে পূজা বন্ধ করা থেকে নিরস্ত করেন। এরপর প্রথম চার বছর পূজা হয়েছিল শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে; দ্বিতীয় চার বছর সারদা দেবীর নামে এবং তৃতীয় চার বছর তার কাকা নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নামে। বারো বছর পর সারদা দেবী পুনরায় পূজা বন্ধ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শোনা যায়, এই বারও জগদ্ধাত্রীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি নিরস্ত হন। জীবদ্দশায় প্রতি বছরই জগদ্ধাত্রী পূজায় উপস্থিত থাকতেন সারদা দেবী। পূজা পরিচালনার জন্য তিনি সাড়ে দশ বিঘার কিছু বেশি জমি দেবোত্তর সম্পত্তিরূপে দিয়ে যান। ১৯১৯ সালে সারদা দেবী এই পূজায় শেষবার উপস্থিত ছিলেন। পরের বছর তিনি প্রয়াত হন।

প্রথম পূজার ঐতিহ্য অনুযায়ী আজও শুক্লা নবমীতে মূল পূজার পরও দুই দিন প্রতিমা রেখে দিয়ে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার মতোই পূজার সঙ্কল্প হয় সারদা দেবীর নামে। জগদ্ধাত্রীর প্রতিমার পাশে জয়া-বিজয়া ও নারদ মুনির প্রতিমা থাকে। নবমীতে ষোড়শোপচারে পূজা, তিন বার চণ্ডীপাঠ ও মাতৃমন্দিরে দরিদ্রনারায়ণ সেবা হয়। দশমীর দিন দশোপচারে পূজা হয়। এই দিন সন্ধ্যারতির পর যাত্রাগানের আসর বসে। একাদশীর দিনও দশোপচারে পূজা ও বিসর্জনকৃত্য সম্পন্ন হয়। এই দিন ধুনুচি নৃত্য, কর্পূরারতি, কনকাঞ্জলি প্রদান প্রভৃতিও অনুষ্ঠিত হয়। ধুনুচি নাচের পর বাদ্যঘণ্টা ও শোভাযাত্রা সহকারে মায়ের দিঘিতে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনে আশ্রমবাসী, অতিথি এবং গ্রামবাসী সকলে অংশ নেন। পূজা উপলক্ষে আশ্রমপ্রাঙ্গনে মেলাও বসে।

অন্নক্ষেত্র, যাত্রায় উজ্জ্বল জগদ্ধাত্রীঃ

নদিয়া জেলার ব্রহ্মশাসন গ্রাম থেকে ধাত্রীগ্রামে এসেছিলেন পণ্ডিত রামভদ্র তর্কসিদ্ধান্ত। টোল খুলে এই গ্রামেই তিনি শুরু করেছিলেন বিদ্যাচর্চা। তাঁর পরিবারের এক সদস্যকে স্বপ্নে রূপ দেখান দেবী জগদ্ধাত্রী। পরে স্নান করতে নেমে পুকুর ঘাটে জলভর্তি ঘড়ার মুখেও সেই একই রূপ প্রত্যক্ষ করেন তিনি। ধাত্রীগ্রামে জগদ্ধাত্রী পুজোর সেই শুরু। পরে দেবীর নামেই এলাকার নাম হয় ধাত্রীগ্রাম। গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় প্রাথমিক স্কুল। স্কুলের দেওয়াল ঘেঁষে দেবীর কংক্রিটের মন্দির। নবমীর দিন এখানে পুজো শুরু হয়। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পুজো সারা হয় একই দিনে। প্রথা অনুযায়ী পুজোর আগের দিন প্রতিমাশিল্পীর বাড়ি থেকে শোভাযাত্রা করে প্রতিমা নিয়ে আসা হয় মণ্ডপে। এর পরে দেবীকে পরানো হয় ডাকের সাজ এবং সোনার গয়না। পুজোর দিন সকাল থেকেই দেবীর কাছে মানত করতে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হন মন্দির প্রাঙ্গণে। তাঁদের জন্য মন্দির প্রাঙ্গণেই হয় ভোগ রান্না। এক এক জন মানতকারীর ভোগ রাখা হয় এক একটি মাটির সরায়। আলাদা করে প্রতিটি মাটির সরাই পুজোয় নিবেদন করেন পুরোহিত। প্রতি বার প্রায় হাজার দেড়েক মাটির সরায় ভোগ রাখা হয়। যার নামে সরা থাকে, তাঁর নাম ও গোত্র ধরে পুজো করেন পুরোহিত।

প্রাচীন এই পুজোর বয়স নিয়ে অবশ্য রয়ে গিয়েছে বিতর্ক। কেউ বলেন, তিনশো। কেউ সাড়ে তিনশো। কেউ বা তারও বেশি। তবে শুরু থেকেই এই পুজো সর্বজনীন। পুজো মন্দির থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে একটি ফাঁকা মাঠ। পুজো শুরুর দিন এই মাঠে বসে অন্নক্ষেত্র। এলাকা এবং বাইরের হাজার হাজার মানুষ এই অন্নক্ষেত্রে সামিল হন। অন্নক্ষেত্রের আসরে প্রায় ৬ কুইন্ট্যাল চাল ও ডাল রান্না হয়। বড় যাত্রার মঞ্চ বাঁধা হয় পুজো মন্দিরের সামনেই। অন্নক্ষেত্র শেষে সেই মঞ্চে শুরু হয় যাত্রা। আগের দিনে টানা এক সপ্তাহ ধরে যাত্রাপালা চলত। এখন অবশ্য তা কমে দাঁড়িয়েছে, এক দিনে। পুজো উপলক্ষে যে অন্নক্ষেত্রের আসর বসে, তার চাল সংগ্রহ করা হয় বাড়ি বাড়ি ঘুরে। এছাড়া দেবীর ডাকের সাজ, ঢাক-সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী বিভিন্ন মানুষ পুজো কমিটির হাতে তুলে দেন। প্রাচীন এই পুজোয় রয়েছে পাঁঠা বলির রেওয়াজ। পুজোর বয়স যত বেড়েছে উৎসব উপলক্ষে জৌলুসও বেড়েছে তত। পুরনো পুজোয় দশমীতেও রয়েছে বিশেষ একটি রেওয়াজ। বিসর্জনের আগে গ্রামের বাসিন্দারা প্রতিমার পাটাতন ধরেই ঘণ্টা দু’য়েক ধরে নাচানাচি করেন। এর পরে মন্দির থেকে কিছুটা দূরে গ্রামের এক পুকুরে প্রতিমার বিসর্জন পর্ব শেষ করা হয়। সেই পুকুরের নামও হয়ে গিয়েছে জগদ্ধাত্রী পুকুর। বিসর্জনের ঠিক আড়াই দিন পরে জল থেকে তোলা হয় প্রতিমার পাটাতন।

কলকাতায় ও অন্যত্র জগদ্ধাত্রী পুজো

দুর্গা ও কালীপুজোর তুলনায় দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও মহানগরীতে জগদ্ধাত্রী পুজোর রেওয়াজ রয়েছে৷ শুধু তাই নয় কৃষ্ণনগর আর চন্দনগরের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলেও ইদানিং এই পুজোর দিকেও নজর পড়েছে কলকাতাবাসীর৷ ফলে নতুন নতুন বেশ কিছু বারোয়ারি পুজোর পাশাপাশি পুরনো বনেদি বাড়িতে এবং মঠ ও আশ্রমে এই পুজো হয়ে থাকে৷ উত্তর কলকাতার বিকে পালের বাড়ির পুজো ১৯০০ সালে শুরু করেছিলেন বটকৃষ্ণ পাল৷ আবার মুক্তরামবাবু স্ট্রিটে দত্ত বাড়ির পুজোও বহু বছর ধরে চলে আসছে ৷ বরাহনগরে সত্যানন্দদেব প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রমে এবং ডাললপে ওঙ্কারনাথ দেবের প্রতিষ্ঠিত মহামিলন মঠেও নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো চলে৷ বারোয়ারি পুজোগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তর কলকাতার শ্যাম পার্কে স্কোয়ার অ্যাথলেটিক ক্লাবের পুজো, রাজবল্লভ পাড়া , বাগবাজার স্ট্রিটের পুজো, বেনিয়াটোলা লেনের পুজো , এসএন ব্যানার্জি রোডের ইযুথ কর্ণারের পুজো৷

জগদ্ধাত্রী স্তোত্রংঃ

ওঁ আধারভূতে চাধেয়ে ধৃতিরূপে ধুরন্ধরে।
ধ্রূবে ধ্রূবপদে ধীরে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
শবাকারে শক্তিরূপে শক্তিস্থে শক্তিবিগ্রহে।
শাক্তাচার প্রিয়ে দেবি জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে।
জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
পরমাণু স্বরূপে চ দ্ব্যণুকাদি স্বরূপিণি।
স্থূলাতি সূক্ষ্ম রূপেণ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম রূপে চ প্রাণাপানাদিরূপিণি।
ভাবাভাব স্বরূপে চ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
কালাদি রূপে কালেশে কালাকাল বিভেদিনি।
সর্ব্ব স্বরূপে সর্ব্বজ্ঞে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
মহাবিঘ্নে মহোৎসাহে মহামায়ে বলপ্রদে।
প্রপঞ্চাসারে সাধ্বীশে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
অগম্যে জগতামাদ্যে মাহেশ্বরি বরাঙ্গনে।
অশেষ রূপে রূপস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
দ্বিসপ্তকোটি মন্ত্রাণাং শক্তিরূপে সনাতনি।
সর্ব্ব শক্তি স্বরূপে চ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
তীর্থযজ্ঞ তপোদান যোগসারে জগন্ময়ি।
ত্বমেব সর্ব্বং সর্ব্বস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
দয়ারূপে দয়াদৃষ্টে দয়াদ্রে দুঃখমোচনি।
সর্ব্বাপত্তারিকে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
অগম্য ধামাধামস্থে মহাযোগীশ হৃৎপুরে।
অমেয় ভাব কূটস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥
যঃ পঠেৎ স্তোত্রমেতত্তু পূজান্তে সাধক উত্তমঃ।
সর্ব্ব পাপৎ বিনির্মুক্তঃ পূজা ফলং অবামুয়াৎ॥
ইতি শ্রীজগদ্ধাত্রীকল্পে জগদ্ধাত্রী স্তোত্রং সমাপ্তম্॥
 

জগদ্ধাত্রীর পুজোই বেশি কল্যাণকরঃ

জগদ্ধাত্রী যে দেবী-শ্রেষ্ঠা তা শোনা যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণের মুখেও। তিনি বলেন, ‘জগদ্ধাত্রীরূপের মানে কী জান? যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন। তিনি না ধরলে জগৎ পড়ে যায়— নষ্ট হয়ে যায়। মনকরীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হয়।’ মদমত্ত হাতি, তার উপরে শক্তির প্রতীক সিংহ আর তার উপরে দেবী জগদ্ধাত্রী। স্বামী নির্মলানন্দ দেবী জগদ্ধাত্রীর মূর্তির বর্ণনা করে বলেছেন তিনিই মানুষের মত্ত মনকে বশ করতে পারেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের মন মত্ত হস্তীর ন্যায় সর্ব্বদা মদান্বিত। সে অস্থির, উন্মাদ। এই দুরন্ত মনকরীকে সদা উদ্যমশীল বিবেকসিংহের দ্বারা মর্দ্দন করতে হবে— মহাশক্তিরূপিণী দেবীর বশীভূত করতে হবে। মন বশীভূত হ’লেই অন্তরে চৈতন্যময়ী জগদ্ধাত্রীর মহাপ্রকাশ অনায়াসলভ্য হয়। শাস্ত্রকার, পুরাণকারদের বক্তব্য, সিংহারূঢ়া জগদ্ধাত্রী যাঁকে রক্ষা করেন তার পতন নেই, বিনাশ নেই।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.