জগজ্জননী ত্রিতাপহারিণী দেবী কুষ্মাণ্ডা!

প্রতিপদ থেকে শুরু হয় নবরাত্রি উৎসব। এই ৯ দিন দেবী নানারূপে পূজিত হন। একেক দিনের পুজো পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য একেকরকম। চতুর্থীর দিন দেবীকে কুষ্মাণ্ডা নামে পুজো করা হয়। বিশ্বাস, এই দিন দেবী দুর্গা বিশ্বের স্রষ্টার রূপ গ্রহণ করেন।

কুষ্মাণ্ডা রূপে দেবী সিংহের উপর অধিষ্ঠিত। দেবী এই রূপে দশ নয়, আট হাতের অধিকারী। দেবীকে বলা হয়, আদিশক্তি বা আদিস্বরূপ। গৌরবর্ণা দেবীর অঙ্গে অঙ্গে তাই সূর্যের মতো ছটা। তিনি সর্ব দুঃখহরণকারী। মা ব্যাধি থেকে মুক্ত করে ভক্তদের ইহলৌকিক পরলৌকিক সমৃদ্ধি দেন।

দেবীর এইরকম অদ্ভুত নাম কেন? জগজ্জননীর পূর্ণ প্রকাশ দেবী কুষ্মাণ্ডার মধ্যে। তিনি মাতৃরূপের পূর্ণ প্রকাশ। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের জননী। সন্তানকে রক্ষা করেন সমগ্র জাগতিক কষ্ট থেকে মুক্ত করেন।

তিনি জগৎ প্রতিপালিকা শক্তি। দেবীকে শুধুমাত্র মালপোয়া ভোগ দিলেই সন্তুষ্ট হন। তন্ত্রে দেবী প্রসঙ্গে যে শ্লোক আছে- “सुरासम्पूर्णकलशं रुधिराप्लुतमेव च । दधाना हस्तपद्माभ्यां कूष्माण्डा शुभदास्तु मे ॥ অর্থাৎ সুরাসর্মপ্ন কলসং রুধিরাপ্লুতমেব চ। দধানাহস্তপদ্মাভ্যাং কুষ্মাণ্ডা শুভদাত্ত মে।।

যদিও তার সঙ্গে এই দেবীর শরীরের সবটা মেলে না। তবে দেবীর নামের অর্থটি খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করা যায়। ‘উষ্মা’ শব্দের মানে তাপ। ‘কু’ মানে কুৎসিত-কষ্টদায়ক তাপ হচ্ছে ‘ত্রিতাপ’। আধিভৌতিক – আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিতাপই জীবের দুঃখের কারণ। সর্বপ্রকার বন্ধনের কারণ ত্রিতাপ। জীব সদা জর্জরিত এই ত্রিতাপে।

দেবী কুষ্মাণ্ডা অষ্টভূজা–তাঁর ডান দিকের চার হাতে থাকে যথাক্রমে পদ্ম, বান, ধনুক ও কমণ্ডলু; এবং বাঁদিকের চার হাতে থাকে যথাক্রমে চক্র, গদা, অমৃতপূর্ণ কলস জপমালা। তাঁর বাহন সিংহ (কাশীতে বাঘ)।

এর হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভই জীবের চরমকাম্য। এই ত্রিতাপ ‘কুষ্মা’ যিনি উদরে ধারণ করেন বা জীবের সকল প্রকার রোগ, জ্বালা, ব্যধী গ্রাস করেন, তিনিই দেবী কুষ্মাণ্ডা। ভিন্ন অর্থে বলা হয়, যখন সমগ্র মহাশুন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, কোথাও কোন বিন্দুর চিহ্ন ছিল না তখন দেবী আদিশক্তি নিজগুনে ব্রহ্মাণ্ড প্রসব করেন নিজ উদর হতে।

ব্রহ্মাণ্ড প্রসবকালে তিনি আনন্দিত ও মৃদু হাস্যময়ী হয়ে তাঁর প্রীতি প্রকাশ করেন, এই দেবী হলেন কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড প্রসবিনী দেবী কুষ্মান্ডা। সন্তানকে রক্ষা করতে জননী তার সমস্ত দুঃখ নিজে হরণ করেন।

স্বামী অচ্যুতানন্দের ভাষায়, “যেমন মহাদেব সমুদ্রমন্থনের সময় সমস্ত হলাহল পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন, তেমনি জগজ্জননী দুর্গা আদ্যাশক্তি জগতের সর্বপ্রকার জ্বালা-যন্ত্রণার হাত থেকে সন্তানদের সর্বদা রক্ষা করতে করুণায় দ্রবীভূত হয়ে স্বেচ্ছায় সব তাপ নিজের শরীরে গ্রহণ করেন। দূরিতবারিণী–‘ত্রিতাপহারিণী’ মায়ের নাম তাই কুষ্মাণ্ডা।

বিশ্বাস, দেবীকে এই রূপে পুজো করলে, ধন, যশ, শক্তি লাভ হয়। পুরাণ বলে, এক কালে জগত সংসার বলে কিছুই ছিল না। শূন্য থেকে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন দেবীই। যখন শ্রী বিষ্ণু সংসার সৃষ্টি করতে বসেন, তখন দেবীর হাসিতেই কেটে যায় অন্ধকার।

উদ্ভাসিত হয় সংসার। সৃষ্টি হয় সব গ্রহ-নক্ষত্রের। অষ্টভুজা দেবীর হাতে থাকে, ত্রিশূল, ঢাল, তলোয়ার, তির-ধনুক প্রভৃতি অস্ত্র। হাতে ধরা দুই পাত্রের একটিতে থাকে মধু, অন্যটিতে রক্ত। আরেক হাতে অভয় দেন দেবী।

পুজোর রীতি:
১. প্রথমে প্রতিষ্ঠিত ঘটের পুজো করে, দেবী ও তাঁর পরিবারের সব দেব-দেবীকে পুজো করতে হয়।
২. এরপর করতে হয় কুষ্মাণ্ডার পুজো।
৩. এরপর মহাদেবের পুজো করতে হয়।
৪. এই পুজো করলে দুর্দশার সময় শেষ হয় বলে ভক্তের বিশ্বাস।

নবরাত্রির চতুর্থ দিনে সাধক তাঁর মনকে অনাহত চক্রে রেখে দেবী কুষ্মাণ্ডার পূজা করেন। তাঁর পূজায় রোগশোক দূরীভূত হয়; ভক্ত আয়ু, যশ, বল ও আরোগ্য লাভ করেন। মনে করা হয়, দেবী কুষ্মাণ্ডা অল্প পূজাতেই সন্তুষ্ট হন। তাঁর পূজায় কুষ্মাণ্ড (কুমড়ো) বলি দেওয়ার রীতি আছে।

কাশীতে দেবী কুষ্মাণ্ডার মন্দির বিখ্যাত। কাশীতে তিনি দুর্গা নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি কাশীর দক্ষিণ দিকের রক্ষয়িত্রী। কাশীতে অসি নদীর সঙ্গমস্থলে কুষ্মাণ্ডার অধিষ্ঠান রয়েছে। দেবীর মন্দিরটি বেশ বড়ো ও বহুচূড়াবিশিষ্ট।

লাল পাথরের তৈরি সুদৃশ্য এই মন্দিরের কাছেই কাশীর বিখ্যাত তীর্থ দুর্গাকুণ্ড। হিন্দুধর্মে অবিশ্বাসীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ এই মন্দিরে। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবী কুষ্মাণ্ডার পশ্চিমমুখী দুই হাত উঁচু বিগ্রহটি অবস্থিত।

কাশীতে একমাত্র এই মন্দিরেই নিয়মিত বলিদান হয় এছাড়া কালরাত্রি মন্দিরে বছরে একবার বলি হয়। শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রির চতুর্থীর দিন অর্থাৎ শুক্ল চতুর্থীর দিন এই মন্দিরে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়।

কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.