কামিকা একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য, তাৎপর্য ও ব্রতবিধি!

সূর্য্যের কর্কট রাশিস্থ বৈষ্ণবীয় ‘শ্রীধর’, বৈদিক “নভস্‌” ও বাংলা নাম অনুসারে “শ্রাবণ” মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিকে ‘কামিকা’ একাদশী তিথি বলা হয়। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে গেলে শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিকে “কামিকা একাদশী” তিথি বলা হয়। এই একাদশী বাংলা ক্যালেন্ডারে‘আষাঢ় – শ্রাবণ’ মাসে পালন করা হয়। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে এটি জুলাই – অগস্ট মাসের সাথে মিলে যায়। বিশ্বাস করা হয় যে, এই ব্রত পালনের মাধ্যমে ব্যক্তির ইচ্ছা পূরণ হয় এবং জ্ঞানে-অজ্ঞানে করা পাপ থেকেও মুক্তি মেলে।

অভিধানগত অর্থে “কম” বা “ক” ধাতুগত শব্দ থেকে “কামনা”, “কামিকা” ইত্যাদি বহু শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। সাধারণভাবে “কম” বা “ক” এর অর্থ হ’ল—(১) অল্প (২) কদাচিৎ (৩) সুন্দর (৪) অপটু (৫) অপকৃষ্ট ইত্যাদি প্রায় ১২৫টি শব্দ। তন্ত্রমতে “ক” এবং “ম” বীজমন্ত্র। মতান্তরে জলজ এবং শিব প্রভৃতি। “কামিকা” {কাম্‌ধাতু + ইক্‌ (ঠন্‌) অস্ত্যর্থে / স্ত্রীং আ (টাপ্‌)} শব্দের অর্থ হ’ল (১) করব পক্ষী (২) কামনায় ভরপুর ইত্যাদি ৫টি শব্দ।

বিশেষ অর্থে বলা হয়—যে একাদশী দেবী তাঁর অনুগত এবং আশ্রয়প্রার্থী ভক্তের মনের বিষয়-কামনা দূর করে দিব্য চেতনা প্রদান করেন তিনিই হলেন “শ্রীশ্রীকামিকা একাদশী দেবী”। মতান্তরে “কামদা” একাদশী দেবী। এই একাদশীর আদিষ্ট দেবতার নাম “শ্রীধর”।

পৌরাণিক আখ্যান থেকে জানা যায় — পাণ্ডববর্গ শ্রীকৃষ্ণকে এই পুণ্য একাদশী প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তখন তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং দেবর্ষি নারদের সূত্র ধরে পাণ্ডবদের জানাচ্ছেন যে, অন্যান্য একাদশীর মতো এই একাদশীও আধ্যাত্মিক জগতের যাত্রীদের সহায়ক, পরম মঙ্গলদায়ক ও আনন্দ দায়ক। শাস্ত্রীয় বিধান মেনে এবং নিষ্ঠাভরে এই ব্রত সমাপন করলে সাধকের বিষ্ণুলোক প্রাপ্তি হয়। শ্রাবণ কৃষ্ণপক্ষীয়া কামিকা একাদশী সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে যুধিষ্ঠির- শ্রীকৃষ্ণ-সংবাদে বলা হয়েছে।

কামিকা একাদশী ব্রতের তাৎপর্য

কামিকা একাদশী মোক্ষ প্রদান করে। কামিকা একাদশী ব্রতের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ। বিশ্বাস করা হয়, এই ব্রত পালনের মাধ্যমে ব্যক্তির সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয়। কামিকা একাদশী ব্রত পূর্ববর্তী জীবনের পাপ থেকেও মুক্তি দেয়। যারা নিজেদের পাপ সম্পর্কে ভয় পায়, তাদের অবশ্যই এই ব্রত করা উচিত। পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একাদশী ব্রতের চেয়ে ভাল আর কোনও দ্বিতীয় উপায় নেই। একাদশীর দিন ভগবান বিষ্ণুর পূজা করা অত্যন্ত লাভদায়ক। মহাভারতে, স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ যুধিষ্ঠির ও অর্জুনকে এই একাদশী উপবাসের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন।

কামিকা একাদশী ব্রতের পূজা বিধি

কামিকা একাদশীর দিন যারা ব্রত করবেন, তাদের খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করা উচিত। প্রথমে ব্রতের সংকল্প গ্রহণ করুন এবং চারিদিকে গঙ্গাজল ছিটিয়ে ও গঙ্গাজল দিয়ে পূজার স্থান শুদ্ধ করে নিন। এই দিনে ভগবান বিষ্ণুর পুজো করা হয়। দুধ, পঞ্চামৃত, ফল, হলুদ ফুল, তিল, ইত্যাদি শ্রীহরিকে অর্পণ করুন। এই দিন বেশির ভাগ সময় ভগবান বিষ্ণুর নাম স্মরণ করে ব্যয় করুন। এই দিনে ব্রাহ্মণ ভোজন করান এবং দক্ষিণা দিন। যদি এটি সম্ভব না হয়, তাহলে আপনার সাধ্যমতো অভাবীদের সাহায্য করুন। একাদশীর পূজায় বিষ্ণু সহস্রনাম পাঠ অবশ্যই করুন।

পৌরাণিক আখ্যানটি হল-

যুধিষ্ঠির মহারাজ শ্রীকৃষ্ণকে বললেন- হে গোবিন্দ! হে বাসুদেব! শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর নাম এবং মাহাত্ম্য সবিস্তারে আমার কাছে বর্ণনা করুন। তা শুনতে আমি অত্যন্ত কৌতুহলী।

প্রত্যুত্তরে ভক্তবৎসল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন-হে রাজন! পূর্বে দেবর্ষি নারদ প্রজাপতি ব্রহ্মাকে এই প্রশ্ন করলে তিনি যে উত্তর প্রদান করেছিলেন আমি এখন সেই কথাই বলছি। আপনি মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ করুন।

একসময় ব্রহ্মার কাছে ভক্তশ্রেষ্ঠ নারদ জিজ্ঞাসা করলেন-হে ভগবান! শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশীর নাম কি, এর আরাধ্য দেবতা কে, সেই ব্রতের বিধিই বা কিরকম এবং এই ব্রতের ফলে কি পুণ্য লাভ হয় তা সবিশেষ জানতে ইচ্ছা করি। আপনি কৃপা করে আমাকে তা জানালে আমার জীবন ধন্য হবে।

শ্রী নারদের কথা শুনে ব্রহ্মা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। তিনি বললেন-হে বৎস! জগৎ জীবের মঙ্গলের জন্য আমি তোমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিচ্ছি, তুমি তা শ্রবণ কর।

শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী ‘কামিকা’ নামে জগতে প্রসিদ্ধা। এই একাদশীর মাহাত্ম্য শ্রবণে বাজপেয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়। ভগবান শ্রীহরির পূজা- অর্চনা অপরিমিত পূর্ণ ফল প্রদান করে। গঙ্গা গোদাবরী কাশী নৈমিষ্যারণ্য পুষ্কর ইত্যাদি তীর্থ দর্শনের সমস্ত ফল একমাত্র কৃষ্ণপূজার মাধ্যমে কোটিগুণ লাভ করা যায়।

সাগর ও অরণ্য যুক্ত পৃথিবী দানের ফল, দুগ্ধবতী গাভী দানের ফল অনায়াসে এই ব্রত পালনে লাভ হয়। যারা পাপপূর্ণ সাগরে নিমগ্ন এই ব্রতই তাদের উদ্ধারের একমাত্র সহজ উপায়। এই রকম পবিত্র পাপনাশক শ্রেষ্ঠ ব্রত আর জগতে নেই। শ্রীহরি স্বয়ং এই মাহাত্ম্য কীর্তন করেছেন। রাত্রি জাগরণ করে যারা এই ব্রত পালন করেন তাঁরা কখনও দু:খ-দুর্দশাগ্র স্ত হন না। এই ব্রত পালনকারী কখনও নিম্নযোনি প্রাপ্ত হন না।

কেশবপ্রিয়া তুলসীপত্রে যিনি শ্রীহরির পূজা করেন পদ্মপাতায় জলের মতো তিনি পাপে নির্লিপ্ত থাকেন। তুলসীপত্র দিয়ে বিষ্ণুপূজায় ভগবান যেমন সন্তুষ্ট হন, মণিমুক্তাদি মূল্যবান রত্ন মাধ্যমেও তেমন প্রীত হন না। যিনি কেশবকে তুলসীমঞ্জরী দিয়ে পূজা করেন তার জন্মার্জিত সমস্ত পাপ ক্ষয় হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে ব্রহ্মা বললেন- হে নারদ! যিনি তুলসীকে প্রত্যহ দর্শন করেন তার সকল পাপরাশি বিদূরিত হয়ে যায়, যিনি তাঁকে স্পর্শ করেন তার পাপমলিন দেহ পবিত্র হয়, তাঁকে প্রণাম করলে সমস্ত রোগ দূর হয়, তাঁকে জল সিঞ্চন করলে যমও তার কাছে আসতে ভয় পান। শ্রী হরিচরণে তুলসী অর্পিত হলে ভগবদ্ভক্তি লাভ হয়। তাই হে কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনী তোমায় প্রণাম করি।

যে ব্যক্তি হরিবাসরে ভগবানের সামনে দীপদান করেন চিত্রগুপ্তও তাঁর পু্ণ্যের সংখ্যা হিসাব করতে পারে না। তার পিতৃপুরুষেরাও পরম তৃপ্তি লাভ করেন।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন-হে রাজন! আমি আপনার কাছে সর্বপাপহারিনী ‘কামিকা’ একাদশীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করলাম। অতএব যিনি ব্রহ্মহত্যা ভ্রুণহত্যা-পাপবিনাশিনী, মহাপুণ্যফলদায়ী এই ব্রত পালন করবেন। এমন কি এই ব্রতকথা শ্রবণ করলেও পুণ্য হয়।

“শ্রুতং মাহাত্ম্যমেতস্যা নরৈঃ শ্ৰদ্ধাসমন্বিতৈঃ।
বিষ্ণুলোকমবাপ্লেতি সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে ।

—ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, একাদশী-১৭।৩১

এই মাহাত্ম্য শ্রদ্ধা সহকারে পাঠ অথবা শ্রবণ করবেন তিনি সর্বপাপ থেকে মুক্ত হযে বিষ্ণুলোকে গমন করবেন।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.