যে কারনে রাস উৎসব পালন করা হয়। শাক্ত ও বৈষ্ণবীয় রাসযাত্রা, ইতিহাস, তত্ত্ব ও তাৎপর্য

রাস হল জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন। রাস যাত্রা সনাতন ধর্মালম্বীদের একটি বাৎসরিক উৎসব। কার্তিক মাসের পূর্ণিমাই রাসপূর্ণিমা। রাস মূলতঃ শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব। ভগবান কৃষ্ণের রসপূর্ণ অর্থাৎ তাত্ত্বিক রসের সমৃদ্ধ কথাবস্তুকে রাসযাত্রার মাধ্যমে জীবাত্মার থেকে পরমাত্মায়, দৈনন্দিন জীবনের সুখানুভূতিকে আধ্যাত্মিকতায় এবং কামপ্রবৃত্তিসমূহকে প্রেমাত্মক প্রকৃতিতে রূপ প্রদান করে অঙ্কন করা হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, এই দিন বৃন্দাবনের গোপিনী সকাশে রাধার সঙ্গে রাস উৎসবে মেতেছিলেন গোপশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ। গোপিনীদের নাচ ও শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল বৃন্দাবনের পবিত্রভূমি। পরবর্তীকালে শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের এই মিলন উৎসবকে শ্রীচৈতন্যদেব নাম-সঙ্কীর্তনের মধ্য দিয়ে রাস মহোৎসবে পরিণত করেন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, কেউ যদি তাঁকে জানতে চায়, তবে তাঁকে অবশ্যই ভক্তির আশ্রয়ে থাকতে হবে। এই দিনে তাই বৈষ্ণব ভক্তরা তাঁদের ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মেতে ওঠেন রাসলীলায়। ভগবত পুরাণের পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত কৃষ্ণঅভিসারে রাধা, গোষ্ঠী অভিসার, গোপীগণের রাগ আলাপ, কৃষ্ণর্তন, রাধানর্তন, গোপীদিগের নর্তন, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান, প্রত্যাবর্তন, পুষ্পাঞ্জলি, গৃহগমন প্রভৃতি পর্যায়ে মহারাস অনুষ্ঠিত হয়। যদিও, ‘রাস-লীলা’ নিয়ে বেশকিছু মত প্রচলিত আছে। এরমধ্যে বহুল জনপ্রিয় দু’টি মত। এই দুই মতেই কেন এই রাস-লীলা তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। কথিত আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচন ও পূর্ণলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। এই থেকেই শুরু হয় ‘রাস মেলা’। আবার অন্য মতালম্বীদের মতে, দুর্গাপুজোর পর পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে ‘লীলা’-য় মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সেই থেকেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে ‘রাস-লীলা’ পালিত হয়ে আসছে।

‘রাস’ শব্দের উৎপত্তি

‘রস’ শব্দ থেকে ‘রাস’-এর উৎপত্তি। মূলত কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে ‘রাস’-এর ক্ষণ। ‘রস’ মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম বা রস অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, হ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম বোঝায়। ‘তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে (২/৭) রস সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ। অর্থাৎ ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন। বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। আর পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের ঘনীভূত আধার। তাঁকে ঘিরেই রাস। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য। যাকে বলা হয় ‘হল্লীবক” নৃত্য। কিন্তু বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটির ভিন্ন অর্থ বহন করে। হিন্দুশাস্ত্রে কথিত আছে রাস পূর্ণিমাতেই কৃষ্ণলীলা করেন। তাই রাস পূর্ণিমাতেই পালিত হয় রাস-লীলা। শ্রীকৃষ্ণ শারদপূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের যমুনাতটে গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাদের অহং বর্জিত বিশ্বাসভক্তি ভাবে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। এই দিনটি বৃন্দাবনে গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের লীলা করার দিন। ‘লীলা’ মানে নৃত্য। ‘চিরহরণ’-এর গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃ্ষ্ণের এই লীলা। কথিত আছে গোপীরা নাকি এই দিনটিতে অপেক্ষা করে কৃষ্ণের ডাকের জন্য। কতক্ষণে তাঁদের প্রাণপ্রিয় সখা কৃষ্ণ লীলা-র জন্য ডাক দেবে তা শোনার জন্য নাকি উন্মুখ হয়ে থাকে গোপীরা। বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব। এক অসামান্য আনন্দ উৎসব।

শব্দগত অর্থ :

“রাসলীলা” শব্দটি এসেছে সংষ্কৃত হতে “রাস” থেকে। রাস শব্দটি মানে, অনুভূতি আর লীলা মানে দৈবিক কার্য্য (devine act), এখানে act বলতে বিশেষ প্রকারের নৃত্য এর কথা বলা হয়েছে। সুতরাং রাসলীলা বলতে একপ্রকার বিশেষ নৃত্য বুঝায়, যা শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমতী রাধারানী গোপীবৃন্দ সহ করেছিলেন। যেখানে সম্পূর্ণ সাত্ত্বিক অনুভূতি, ভালোবাসা আর আনন্দ বিদ্যমান ছিলো। (Dance of Shree Krishna with Gopis, performed with full of emotions, love and bliss”.) এককথায়, রাস হলো, দৈবিক নৃত্য। এ যেন আধ্যাত্মিকতার আড়ালে এক অসামান্য প্রেম কাহিনি। প্রেমের সর্বোচ্চ উচ্চতায় মনের বন্ধহীন ডোরই যেন এখানে উপজীব্য। ভালবাসা এখানে ‘শারীরিক’ কোনও চাহিদা নয় এক ‘মিলনের তিতিক্ষা’। আর এই মিলন পুরোটাই আধ্যাত্মিক, যাকে আমরা বলি ‘প্ল্যাটোনিক’। এই কারণে আজও কার্তিক পূর্ণিমায় বারবার ফিরে আসে রাস-লীলার অসামান্য প্রেমকাহিনি। দুর্গাপুজোর মতো জাক-জমক না থাকলেও হিন্দুদের অন্যতম এক বড় উৎসব রাস। তবে অঞ্চল বিশেষে রাস-এর প্রভাব এবং জমক কিন্তু বিশাল রকমের।

রাস উৎসবের তাৎপর্য

পদ্মপুরাণে (৫২/১০৩-১০৫) শারদরাস ও বাসন্তীরাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়) বাসন্তীরাস এবং শ্রীমদ্ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণে (৫/১৩/১৪-৬১) শুধুমাত্র শারদরাসের বর্ণনা আছে। হরিবংশে ও ভাসের বালচরিতে উল্লেখ আছে যে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে হল্লীশনৃত্য করেছিলেন। হল্লীশনৃত্য যদি তালযুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে তাকে “রাস” নামে অভিহিত করা হয়। বিষ্ণুপুরাণের মতে, কৃষ্ণ রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন গোপরমণীদের সঙ্গে। শ্রীধর স্বামী বলেছেন, বহু নর্তকীযুক্ত নৃত্য বিশেষের নাম রাস– “রাসো নাম বহু নর্ত্তকীযুক্তে নৃত্যবিশেষঃ।” শ্রীমদ্ভাগবতের অন্যতম টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, —“নৃত্যগীতচুম্বনালিঙ্গনদীনাং রসানাং সমূহো রাসস্তন্ময়ী যা ক্রীড়া বা রাসক্রীড়া”। শ্রীমদ্ভাগবতের মতে, কৃষ্ণ যোগমায়াকে সমীপে গ্রহণ করেই রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন। বস্ত্রহরণের দিন গোপিনীদের কাছে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি রাসলীলা করবেন-

“যখন করেন হরি বস্ত্রহরণ।
গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ।।
আগামী পূর্ণিমাকালে তাঁহাদের সনে।
করবেন রাসলীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।।”
 

শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীবৃন্দ আপনাপন কর্তব্যকর্ম বিসর্জন দিয়ে সংসারের সকল মোহ পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পন করেছিলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের স্ব-গৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন; বলেন, তাদের সংসার-ধর্ম পালন করা উচিত। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে দৃঢ় ছিলেন। ভগবান ভক্তের অধীন। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের দৃঢ়ভক্তি দেখে তাদের মনোকামনা পূরণার্থে রাসলীলা আরম্ভ করেন। কিন্তু যখনই শ্রীকৃষ্ণ তাদের অধীন বলে ভেবে গোপিনীদের মন গর্ব-অহংকারে পূর্ণ হল, তখনই শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মধ্য থেকে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন রাধাকে নিয়ে উধাও হলেন, তখন গোপিনীবৃন্দ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। ভগবানকে ‘একমাত্র আমার’ বলে ভেবে অহংকারের ফলে শ্রীকৃষ্ণকে তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ত্রিজগতের পতি, তাই তাকে কোনো মায়া-বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় না। তখন গোপিনীবৃন্দ একাগ্রচিত্তে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করতে শুরু করেন। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দিয়ে তাদের অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। গোপিনীদের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান জানিয়ে ‘যতজন গোপিনী, ততজন কৃষ্ণ’ হয়ে গোপিনীদের মনের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন আর গোপীবৃন্দও জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। এইভাবে জগতে রাসোৎসবের প্রচলন ঘটে।

কৃষ্ণে বিরুদ্ধহৃদয়া ইদমূচুঃ পরস্পরম্।
কৃষ্ণোহহমেতল্ললিতং ব্রজাম্যাক্যতং গতিং ||
অন্যা ব্রবীতি কৃষ্ণস্য মম গীতির্নিশাম্যতাং।
দুষ্ট কালিয়! তিষ্ঠাত্র কৃষ্ণোহহমিতি চাপরা।
বাহুনাস্ফোট্য কৃষ্ণস্য লীলাসর্ব্বস্বমাদদে ||
অন্যা ব্রবীতি ভো গোপা নিঃশঙ্কৈঃ স্থীয়তামিহ।
অলং বৃষ্টিভয়েনাত্র ধৃতো গোবর্দ্ধনো ময়া ||
 

অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মার যে ভেদজ্ঞান পরমাত্মা রুপী কৃষ্ণের কৃপা লাভ, জ্ঞানের তাহাই চিরোদ্দেশ্য। মহাজ্ঞানীও সমস্ত জীবন এর সন্ধানে ব্যয়িত করেও এটি পাওয়া হয় না। কিন্তু এই জ্ঞানহীনা গোপকন্যাগণ কেবল জগদীশ্বরের সৌন্দর্য্যের অনুরাগিণী হয়ে সেই জ্ঞান প্রাপ্ত করে ঈশ্বর সাক্ষাৎ করল।

রাস নৃত্যঃ

রাসলীলায় যে নৃত্য পরিবেশন করা হয় সেটাই রাসনৃত্য নামে পরিচিতি। রাসনৃত্যও গোলাকার মণ্ডপে কখনও একক, কখনও দ্বৈত এবং কখনও দলবেঁধে পরিবেশিত হয়। অদৃশ্য রসের দৃশ্যমান রূপই হলো রাস। রাসনৃত্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত ; যথাঃ “মহারাস”, “বসন্ত রাস”, “কুঞ্জরাস”, “দিব্যরাস” ও “নিত্যরাস”। এর মধ্যে “মহারাস” জাঁকজমকপূর্ণ। রাসনৃত্যের মূল বিষয়বস্তু হলো রাধা ও তার সখীদের নিয়ে। এ নৃত্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের শুরু, মান-অভিমান এবং শেষে মিলন দেখানো হয়। রাসনৃত্যে সাধারণত রাধা ও কৃষ্ণের ভূমিকা দেয়া হয় শিশুদের, যাদের বয়স পাঁচের কম। সনাতনীদের বিশ্বাস, এই বয়সের পর শিশুদের দৈবশক্তি লোপ পেয়ে যায়। তবে প্রকৃত নাটনৃত্য ও গীত পরিবেশন করে তরুণীরা, যারা রাধার সহচরী হিসাবে মঞ্চে আসে। রাসনৃত্যের কেন্দ্রবিন্দু ভঙ্গি পরেং অর্থাৎ নৃত্যমালিকা। রাসলীলা শুরু হয় নট সঙ্কীর্তন দিয়ে। গোবিন্দজীর মন্দিরের বিশাল মণ্ডপে আরাধ্য দেবতার মূর্তির সামনে শিল্পীরা মৃদঙ্গ ও করতাল সহযোগে সঙ্কীর্তন করে। বিশেষ পোশাকে সাজেন শিল্পীরা। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বন্দনা দিয়ে শুরু হয়ে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ব্যাপী রাসসঙ্গীত অনুষ্ঠিত হয়। রাসনৃত্যের মাধ্যমে ভক্ত-শিল্পীরা শ্রীকৃষ্ণের সাথে আবেগসূত্রে মিলিত হয়। বাংলা, মৈথিলী, ব্রজবুলি ও মৈতৈ কবিদের পদাবলি থেকে রাসনৃত্যের গীত গাওয়া হয়। হর্ষচরিতের টীকাকার শঙ্করের মতে, রাস হলো এক ধরনের বৃত্তাকার নাচ যা আট, ষোলো বা বত্রিশ জনে সম্মিলিতভাবে উপস্থাপনা করা যায়। বাংলাদেশে সহ ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা ও বৃন্দাবনে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়াসহ অন্যান্য জায়গায়, ওড়িশা, আসাম ও মণিপুরে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা উৎসব বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। এই উৎসবের অংশ হিসেবে গোপিনীবৃন্দ সহযোগে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা এবং অঞ্চলভেদে কথ্থক, ভরতনাট্যম, ওড়িশি, মণিপুরি প্রভৃতি ঘরানার শাস্ত্রীয় ও বিভিন্ন লোকায়ত নৃত্যসুষমায় রাসনৃত্য বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।

নবদ্বীপে শাক্ত রাস উৎসব

বৈষ্ণবদর্শনে রাসের যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, বৈষ্ণব আখড়ায় যে ভাবেই রাস পালিত হোক না কেন, শহর নবদ্বীপ, চৈতন্যজন্মভূমি নবদ্বীপে রাসের চেহারা ঠিক এর ‘বিপরীত’। রাস নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ উৎসব। শরৎকালে শারদোৎসবের পরেই শুরু হয় উৎসবের প্রস্তুতির বাড়বাড়ন্ত; কার্তিকীপূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয় নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ লোকায়ত উৎসব “রাস”। এখানকার রাসের প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে মূর্তির বিশালতা। অপরূপ মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে নানারূপে শক্তি আরাধনাই নবদ্বীপের রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি মূর্তিতে কত কারুকার্যময় নির্মাণশৈলী, কত বিচিত্র রূপকল্পনা, কত ব্যাপক ধর্মীয় ব্যঞ্জনা, কত পণ্ডিতের গভীর উপলব্ধির সুস্থিত বহিঃপ্রকাশ, কত শিল্পীর নিখুঁত চিত্রায়ণ—যা সম্মিলিত রূপে অসংখ্য মানুষের মনোরঞ্জনে সহায়তা করে। নবদ্বীপের রাস শুধুমাত্র উৎসব নয়, ধর্মীয় দ্যোতনার এক ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি। রাস মূলতঃ কৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব; কিন্তু নবদ্বীপের রাস প্রধানত শাক্ত রসাশ্রিত। আবহমানকাল থেকে এখানকার ধর্ম-সংস্কৃতিতে তান্ত্রিক বীরাচারের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। মদ-মাংস (পঞ্চমকারের প্রধানবস্তু) এবং আড়ম্বরের জৌলুস ব্যতীত বীরাচারের আরাধনার পূর্ণতা ঘটে না।

নবদ্বীপের রাসে অনিবার্যভাবেই ঘটেছে তন্ত্রাচারের পূর্ণ প্রতিফলন। পূর্ণিমার ভরা রাতে, বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো, সঙ্গে আদ্যন্ত তামসিকতায় ভরা এক দামাল উৎসবের উদযাপন— সংক্ষেপে এটই হল নবদ্বীপের রাসের সংজ্ঞা। পূর্ণিমার রাতে দেড়শোর বেশি বিরাট বিরাট শক্তিমূর্তির পুজোর কারণে নবদ্বীপের রাসকে অনেকে ‘শাক্ত রাস’ বলেও অভিহিত করেন। নবদ্বীপের রাসের উৎস ঠিক কবে, এর উত্তরে স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক ও নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৭২৮-৮২) রাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল। রাজা হওয়ার পর থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন। তার পর থেকে তিনি মঠমন্দির স্থাপন, মেলা উৎসবের সূচনা বা বহু জনকল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশন করেন। ১৭৫৩-৫৬-র মধ্যে তিনি জগদ্ধাত্রীপুজো, বারোদোলের সূচনা করেন। মনে করা হয় ওই একই সময়ে তিনি নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের রাস উৎসবের খোলনলচে বদলে দেন। শান্তিরঞ্জনবাবু আরও বলেন, কৃষ্ণচন্দ্র নিজে ছিলেন শাক্ত। নদিয়া, অগ্রদ্বীপ, কুশদ্বীপ এবং উলা এই চারটি সমাজের সমাজপতি। তার রাজত্বে শুদ্ধাচারে শক্তিসাধনা হোক এটা তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন। পাশাপাশি তিনি পছন্দ করতেন না চৈতন্যদেবকে মঠে-মন্দিরে পুজো করা হোক। তিনি বৈষ্ণববিদ্বেষী ছিলেন না, কিন্তু চৈতন্যদেবকে যাঁরা অবতার বলে পুজো করতেন তাঁদের তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন। চৈতন্যদেবের অনুগামীরা বেদবিধি ও ব্রাহ্মণ্যস্মৃতি মানতেন, এটাও কৃষ্ণচন্দ্রের আপত্তির কারণ ছিল। তিনি রাসপূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে শক্তিমূর্তি পুজোয় উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে।

মণিপুরিদের রাস উৎসব

মণিপুরিদের সব থেকে বড় উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরণ বা রাসপুর্ণিমা নামের মণিপুরিদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রী: থেকে) পালিত হয়ে আসছে। কার্ত্তিকের পুর্ণিমা তিথিতে দুরদুরান্তের লক্ষ লক্ষ ভক্ত-দর্শক মৌলবীবাজার জেলার সিলেটের কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামণ্ডপের এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষণে ছুটে আসেন। কথিত আছে, রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র একদিন স্বপ্নে দেখতে পান রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলা। তারপর তিনি স্বপ্নের আলোকেই উপস্থাপন করেন রাসলীলার রাসনৃত্য। তিনি কয়েকজন কুমারী মেয়ে দিয়ে স্বপ্নের মতো রাসলীলা করান। তার নিজ মেয়ে কুমারী বিশ্বাবতীকে শ্রীরাধা এবং মন্দিরের শ্রীগোবিন্দকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাসলীলা করেন এবং তিনি নিজেই ওই রাসে মৃদঙ্গবাদক ছিলেন। তাতে তিনি নিজস্ব তাল ব্যবহার করেন। তার সে তালই এখন পর্যন্ত চলছে। অন্য সুত্র থেকে জানা যায়, ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুরের মহারাজ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেন তা-ই রাসনৃত্য। মহারাজার মৃত্যুর একশ বছর পরে মহারাজ চন্দ্রকীর্তির শাসনামলে গোটা রাসনৃত্য আচৌকা, বৃন্দাবন, খুডুম্বা, গোস্ট, গোস্ট বৃন্দাবন, আচৌবা বৃন্দাবনসহ নানা ভঙ্গির পর্যায়ে পড়ে। তার মৃত্যুর পর মহারাজ চন্দ্রকীর্তি এ উৎসবকে আরও বেশি জনপ্রিয় করতে উৎসবকে মণিপুরিদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। আমরা আগেই জেনেছি, মণিপুরিদের তিনটি গোত্র। এর একটি মৈতেই, আরেকটি বিষ্ণুপ্রিয়া সবশেষ মৈতেই পাঙান। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতেই গোত্রের লোকরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। এরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত। এছাড়া মৈতেই পাঙানরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তবে সব মণিপুরিরই প্রধান বার্ষিক উৎসব রাসপূর্ণিমায় রাসলীলা। কিছু তথ্য ও উপাত্ত মারফত জানা যায়, ১৮৪২ সালে মাধবপুরের জোড়া মণ্ডপেই মণিপুরি রাজ্যের বাইরে প্রথম রাসলীলার সূত্রপাত। বাংলা, মৈথিলী, ব্রজবুলি ও মৈতৈ কবিদের পদাবলী থেকে রাসনৃত্যের গীত গাওয়া হয়। ১৯২৬ সালে সিলেটে বেড়াতে এসে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশী মণীপুরী আদিবাসীদের রাস-নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন। এই নাচের কোমল আঙ্গিক রবীন্দ্রনাথের কবিমনকে আলোড়িত করেছিল। পরবর্তীকালে এই মণিপুরীদের এই রাস-নৃত্যকে নিজের সাহিত্য সৃষ্টির আঙিনায় ঠাঁই দেন রবীন্দ্রনাথ। আর এভাবেই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে পরিচিতি পায় বাংলাদেশী মণীপুরীদের এই উৎসব। বিশাল জনসমষ্টির কাছে পৌঁছয় বাংলাদেশী মণিপুরী আদিবাসীদের রাস-নৃত্যের মাহাত্ম্য।

রাসপূর্ণিমায় রাসলীলা উৎসবের শুরুটা হয় গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য দিয়ে। এ নৃত্য হয় সকালে। যারা রাখাল নৃত্য করে, তারা প্রথমে মণ্ডপে গোল হয়ে গোপী ভোজন করে। গোপী ভোজন হল বিভিন্ন সবজি দিয়ে রান্না করা তরকারি ও ভাত। এ খাবার খেয়েই রাখাল নৃত্য শুরু করে শিল্পীরা। সকালে শুরু হয়ে রাখাল নৃত্য একটানা চলে বিকেল পর্যন্ত। মণিপুরি শিশু-কিশোররা এ নৃত্য পরিবেশন করে। যারা নৃত্য করে, তারা এক ধরনের বিশেষ পোশাক পরে। ঝলমলে এ বিশেষ পোশাকের নাম ‘পলয়’। এ পোশাকের পরিকল্পনা করেছিলেন রাজা ভাগ্যচন্দ্র। রাখাল নৃত্যের মূল বিষয়বস্তু হলো কৃষ্ণ ও তার সাথীদের নিয়ে। গোলাকার মণ্ডপে কখনও একক, কখনও দ্বৈত এবং কখনও দল বেঁধে এ নৃত্য পরিবেশিত হয়। রাখাল নৃত্যের পাশাপাশি দিনভর চলতে থাকে মণিপুরিদের নিজস্ব সংস্কৃতির কর্মকাণ্ড। সন্ধ্যার পর শুরু হয় রাসপূর্ণিমার রাসলীলা বা রাসনৃত্য। রাসনৃত্য পরিবেশনা করে মণিপুরি কুমারি মেয়েরা। রাস নৃত্যের সময়ও পলয় পরা হয়। পলয় পোশাকের মাথার উপরিভাগের নাম ‘কোকুতম্বি’। এ পোশাকের মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ আবরণ থাকে। তার নাম ‘মাইমুখ’। গায়ে থাকে সোনালি ও রূপালি চুমকির কারুকাজের ঘন সবুজ ভেলভেটের বস্নাউজ। পরনে থাকে ঘন সবুজ রঙের পেটিকোট, যা শক্ত বক্রমের দ্বারা গোলাকৃতি ও ভাঁজমুক্ত করা হয় এবং অজস্র চুমকি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়নার দ্বারা কারুকাজ করা থাকে, যা সামান্য আলোতেও ঝলমল করে ওঠে। পলয়ের এ অংশের নাম ‘কুমিন’। জরির কারুকাজ করা পেশোয়ান খাওন, খবাংনপ পলয়ের অংশ। এছাড়া পলয়ের সঙ্গে কলথা, খবাংচিক, খুঁজিসহ ইত্যাদি স্বর্ণালঙ্কারও নৃত্যশিল্পীরা পরেন। রাসলীলা উপলক্ষে মণিপুরিরা বিভিন্ন সবজি, ডাল, গাছের লতাপাতা দিয়ে উতি, পাকাউরা, সৈবুম, ইরোলবা নামের বিশেষ খাবার তৈরি করে। ম-পে সবাই লাইন ধরে বসে কলাপাতায় এ খাবার খান। এছাড়া মণিপুরি মেয়েরা নিজেদের তাঁতে বোনা শাড়ি পরেন। এসব শাড়ির নকশা হয় কালো রঙের পাড় এবং সবুজ, খয়েরি, ছাইসহ বিভিন্ন রঙের লম্বা চেকের মাধ্যমে। এছাড়া পুরুষরা পরে সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি, আর গলায় থাকে ওড়না।

ইতিহাসের পাতা থেকে কোচবিহারের মদনমোহনের রাসযাত্রা

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পুজোর আমেজ কাটতে না কাটতে শুরু হয় রাস। আর এই রাস উদযাপনে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গের মানুষের আগ্রহ যেন একটু বেশি। এর কারণ অবশ্যই কোচ বিহারের মদনমোহন। কোচ বিহারের রাসের মেলা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশ জুড়ে বিখ্যাত। প্রতি বছর মদনমোহন মন্দিরে রাস উৎসব দেখতে আসেন দেশ, বিদেশের পর্যটকরা। অনেকে মনে করেন, মদনমোহনকে মনে প্রাণে পূজা করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। শোনা যায় ভৌতিক উপদ্রবের কোচবিহার রাজ্যের ভেটাগুড়িতে চলে আসেন মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ। ১৯১১ সালে রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সময়কালে আসাম থেকে এখানে এসেছিলেন বৈষ্ণব গুরু শঙ্করদেব। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে এসে তিনি বলেন, শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গে রাধারানি বলে কিছু হয় না। আসলে একই অঙ্গে তাঁর দুই রূপ। এই ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছে কোচবিহারের মদনমোহন বিগ্রহ। ১৮১২ সালে কোচবিহারের ভেটাগুড়িতে প্রথম রাসমেলার আয়োজন করা হয়। ওই বছর রাসপূর্ণিমা তিথিতে কোচবিহারের মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ ভেটাগুড়িতে নব নির্মিত রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন। সেই উপলক্ষে সেখানে রাসমেলার আসর বসে। তার পর ১৮৯০ সালে কোচবিহার শহরের বৈরাগী দিঘির পাড়ে মদনমোহন মন্দির নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়। আকৃতিতে মন্দিরটি চারচালা। জানা যায়, মদনমোহনের বিগ্রহটি আদতে কোচবিহারের মহারাজের গৃহদেবতা। বর্তমানে রুপোর সিংহাসনে নানা আভরণে ভূষিত রয়েছেন অষ্টধাতুর মদনমোহন। কোচবিহারের প্রবীণদের কথায়, ১৮১২ সালে রাসপূর্ণিমার দিন মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ সন্ধ্যাবেলায় মানসাই নদী পেরিয়ে নতুন রাজধানী ও রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন এবং সেখানেই গৃহদেবতা মদনমোহনের রাসমেলার সূচনা করেন। সেদিন সেই উপলক্ষে বসেছিল প্রথম রাসের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পরে কোচবিহারের রাজপ্রাসাদ এলাকায় স্থানান্তরিত হয় এই মেলা। কোচ বিহারের মদনমোহন মন্দিরে মোট পাঁচটি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে একটি করে দেবী বিগ্রহ রয়েছে। ওই বছর থেকেই মন্দির লাগোয়া এলাকায় মেলা বসছে বলে ইতিহাস গবেষকদের ধারণা। ১৯১৭ সাল নাগাদ ‘প্যারেড গ্রাউন্ড’-এ মেলা স্থানান্তরিত হয়, এখন যেটা রাসমেলার মাঠ নামেই পরিচিত। আয়তন বেড়ে যাওয়াতেই মেলার মাঠ সরানো হয়েছিল। ১৯২৮ সালে মেলায় প্রথম বিদ্যুতের আলো ব্যবহার করা হয়। গত বছর, অর্থাৎ ২০১২ সালে রাসমেলার দু’শো বছর পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে এক বছরই মেলা বন্ধ ছিল। সালটা ১৯২৩। শহরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ায় মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতি বছর মদনমোহন মন্দিরে রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা হয় রাতে। দিনভর উপোস করে পুরোহিতের পাশে বসে বিশেষ পুজো করেন ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি। পুরোহিতের নির্দেশ মেনে মন্ত্রোচ্চারণের পর রাসচক্র ঘুরিয়ে রাস উৎসবের সূচনা করেন তিনি। তার পর ওই রাসচক্র ঘোরানোর সুযোগ পাবেন দর্শনার্থীরা। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কোচবিহারের মহারাজারা ওই রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা করেছেন। মেলা চলা পর্য্যন্ত রাসচক্র ঘোরাতে উপচে পড়ে ভিড়।

রাসচক্র ও আলতাফ মিঁঞা

বংশানুক্রমিক ভাবে রাসচক্র তৈরির কাজের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন কোচবিহার শহর লাগোয়া হরিণ চওড়ার একটি মুসলিম পরিবার। ওই পরিবারের উত্তরসূরি আলতাফ মিঁঞার দায়িত্বে এখন রাসচক্র নির্মাণ হয়। তিনি লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে চক্র গড়ার কাজ শুরু করেন। বাঁশ কেটে বাতা তৈরি করে শুকিয়ে কাগজের কারুকাজ, পাট দিয়ে গড়া দেবদেবীর ছবি আটকানো সবটাই নিজের হাতে। তাই ২২ ফুট উঁচু কোচবিহারের রাসচক্র যেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক। আলতাফ জানিয়েছেন, ‘‘প্রায় ৩০ বছর ধরে আমি রাসচক্র গড়ছি। ছেলেকেও শেখাচ্ছি। আমার আগে দাদু পান মহম্মদ মিঁঞা, বাবা আজিজ মিঁঞা এই কাজ করেছেন। পরম্পরাটা ধরে রাখতে চাই।’’

কেন এই দিব্যভাব?

দেখতে পাচ্ছেন সুধীজন ওই…ওই যে বৃন্দাবন…যমুনার তীর। ধীরে ধীরে সাঁঝ নামছে যমুনা তীরে। পাখিরা কুলায় ফিরে যাচ্ছে…সাঁঝবেলায় গোপীরাও যমুনার জলে গা ধুয়ে তাদের ঘরে ফিরে গিয়েছে। ঘরের কাজে ব্যস্ত তারা। যমুনার আশেপাশে জঙ্গল জুড়ে নেমে আসছে ঘন অন্ধকার। সেই ঘন অন্ধকার ফুঁড়ে একসময় আকাশে ওঠে চাঁদ। গোল থালার মত…আকাশকে রক্তিম আভায় রাঙিয়ে দিয়ে। এই চাঁদ সাধারণ চাঁদ নয়। বহুদিন বাদে স্বামী ঘরে ফিরে এসে যেমন স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় – এই চাঁদ যেন সেই বিরহাতুর স্বামীর প্রতিভূ। শুধু তাই নয় এ চাঁদ যেন দিব্যভাবে উদ্ভাসিত। কারণ এই কার্ত্তিক পূর্ণিমার রাতেই যে অনুষ্ঠিত হবে রসিক কৃষ্ণের রাসলীলা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে লীলা করবেন। ‘চীরহরণের’ পর গোপীদের সঙ্গে তাঁর এই লীলা। গোপীরা অধীর অপেক্ষা করছে কবে তাদের ডাক আসবে তাদের প্রাণপ্রিয়সখা শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে। ডাক আসবে গো আসবে। তাই আজ কার্ত্তিক পূর্ণিমায় ঐ সুগোল চাঁদের মায়াময় নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে বনাঞ্চলে। রক্তিম চাঁদকে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে রাধারাণীকে। অমনই সুন্দর চাঁদপানা মুখ রাধারাণীর। তোমরা যেসব স্বামীরা দূর বিদেশে অনেকদিন অতিবাহিত করে স্বস্থানে ফিরে এসেছো তারা তোমাদের লজ্জাবনতা প্রেয়সীর মুখে মাখিয়ে দিও কুমকুমের রক্তরাগ। দেখো প্রেয়সীর মুখখানি রাধারাণীর মতই চন্দ্রানন হয়ে উঠেছে কি না!

দীর্ঘ অসন্দর্শনে সখার মন আজ বিরহকাতর। প্রাণপ্রিয়া-র সঙ্গে মিলনের আকাঙ্খায় তার মন ক্ষত-বিক্ষত। ফিরে আসে যেন বৈষ্ণব পদাবলীর সেই পদ– ‘সই কে বা শোনাইলো শ্যামনাম, কানের মরমে পশিল গো আকুল করিল মোর প্রাণ’। যমুনার জলে শরীর ধুয়ে সন্ধ্যাকাশে ঘরে ফিরেছে গোপীদের দল। কিন্তু, ক্ষণিকের ঘন অন্ধকার কাটিয়ে যেন আকাশ ফুড়ে বেরিয়ে এল সুগোল চন্দ্র। দিব্যকান্ত তার চেহারা। বৃন্দাবন আলোকিত। সোনালী থালার মতো সেই চন্দ্রের আলোয় যে আবেগের বিস্ফোরণ। প্রতীক্ষার তিতিক্ষা মিটিয়ে মিলনের এক বার্তা। চারিদিকে বেজে উঠল কৃষ্ণ বাঁশরী। ঘর ফেলে বৃন্দাবনের পাড়ে ছুটল গোপীরা। হিন্দুশাস্ত্র থেকে ভাষা-সাহিত্য বা বৈষ্ণব পদাবলী সবখানেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমার চাঁদের তুলনা টানা হয় দীর্ঘদিন বিদেশ-বিভুইয়ে পড়ে থাকা সখাদের।

এই শারদ রাত, এই চাঁদ, চারিদিক মাতাল করা মল্লিকার গন্ধ – এসব কিছুই সাধারণ নয়, এক দিব্যভাবে স্নাত – অলৌকিক এক মায়ায় আচ্ছন্ন। ভগবান কৃষ্ণ যখন দেখলেন ঐ পূর্ণচন্দ্র ধীরে ধীরে রক্তিম থেকে গৈরিক বর্ণ ধারণ করল এবং সমগ্র অরণ্য প্লাবিত হল জ্যোৎস্নায় তখন তিনি তাঁর হাতে তুলে নিলেন মোহন বাঁশি। ফুঁ দিলেন বাঁশিতে। মধুর বংশীধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল বনে বনাঞ্চলে, যমুনার তীরে…। ওহ্, কি মধুঢালা সে সুর! সেই মন মাতাল করা সুর শোনা মাত্রই গোপীদের মন উন্মনা হল। আশ্চর্য এই সুর কেবল গোপীরাই শুনতে পেল, যারা কৃষ্ণপ্রেমে পাগল – কৃষ্ণ যাদের প্রাণপ্রিয়সখা।। আর কেউ শুনতে পেল না সেই সুর। এমনকি মা যশোদাও নন। এই সুর এমনই সুর যা গোপীদের তীব্রভাবে আকর্ষণ করল। যেন এই সুর আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলল গোপীদের আর রশির মত টেনে নিয়ে আসতে লাগল তাদের কানহাইয়ার দিকে। বৃন্দাবনের সকল তরুণী গোপী যারা কৃষ্ণের প্রেয়সী – তাদের মন বাঁধা পড়ল কানহাইয়ার সাথে। তারা একে অপরের মনোভাব না জেনেই ছুটে চলল সেই বাঁশির সুরের অনুসন্ধানে। কোথায় কৃষ্ণ?

কৃষ্ণের এই বাঁশির সুর ছিল ‘অনঙ্গ বর্দ্ধনম’। কেউ যদি ভগবানকে স্পর্শ করার জন্য উন্মুখ হয় বা খাওয়াবার জন্য ব্যাকুল হয় কিংবা ভগবানের কাছ থাকে আনন্দ পেতে চায় বা তাঁকে আনন্দ দিতে চায়, তখন তাকে বলে অনঙ্গ। ‘অনঙ্গ’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘কাম’। কিন্তু গোপীদের সম্পর্কে অনঙ্গ শব্দের এমন স্থূল অর্থ করা অপরাধ। কৃষ্ণের প্রতি তাদের প্রেম আধ্যাত্মিক – জাগতিক নয়। তাদের সবটুকু দিয়ে তারা কৃষ্ণকে ভালবেসেছে। সেখানে কোন স্বার্থ নেই, কোন দ্বন্দ্ব নেই। তাই কৃষ্ণের বাঁশি তাদের সেই প্রেমকে আরো আরো ঘনীভূত করেছে। যেমন ধোঁয়ার আড়ালে আচ্ছাদিত আগুন বাতাস লাগলে যেভাবে দ্বিগুণবেগে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি গোপীরা কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে উঠল।

বাঁশি যেন বলছে, ‘সখীরা, তোমরা তাড়াতাড়ি এসো। আমি তোমাদের জন্য আকুলভাবে অপেক্ষা করে চলেছি। এই স্থান – এখানে কোন জনমানব নেই – নির্জনতায় ঢাকা – নিশীথ রাত্রি এখানে বড় মায়াময় – মল্লিকার সৌরভে আর চাঁদের আলোয় এই স্থান যেন প্লাবিত হচ্ছে। ওগো, গোপীগণ, তোমরা যে যেখানে যে অবস্থায় আছো, চলে এসো’। বাঁশির সুর চুম্বকের মত আকর্ষণ করল গোপীদের। তারা কেউ কেউ গোরুর দুধ দুইছিল, কেউ বা উনুনে দুধ গরম করছিল। যেই বাঁশির সুর কানে গেল অমনি তারা দুধ দোওয়া ফেলে ছুটল – গোরুর পা বাঁধা রইল, বাছুরটিকে মায়ের কাছে এনে দিতে ভুলে গেল, উনুনে দুধ উথলে উঠল – না, কোন দিকে নজর নেই – সব ছেড়ে গোপীরা ছুটল। কর্মত্যাগ হল তাদের – যতিকর্ম ত্যাগ। কেউ কেউ আবার পতিসেবা করছিল বা সান্ধ্য আহার প্রস্তুত করছিল অথবা প্রসাধন করছিল, অঙ্গরাগে অঙ্গমার্জনা করছিল বা পোশাক পরিধান করছিল – সব কাজ তাদের অসম্পূর্ণ রইল – তারা ধাবিত হল কৃষ্ণসন্দর্শনে। তাদের লোকত্যাগ হল অর্থাৎ পরিবার পরিজন আর তাদের আপন রইল না। কেউ কেউ দুগ্ধপানরত ছোট শিশুকে ফেলে ছুটল – পড়শী, পরিজনরা বলল পাষাণী মা – গোপীদের কানে গেল না সেকথা – তারা শিশু ফেলে ছুটল। স্নেহ বা প্রেম ত্যাগ হল তাদের। কেউ কেউ ছুটল ভোজন ত্যাগ করে। আবার কেউ বা বস্ত্র অলংকার পরিধান করছিল। সেসব অসমাপ্ত রইল। আলুথালু বেশভূষা নিয়েই তারা ছুটল কৃষ্ণসকাশে। দেহস্মৃতি বা দেহবোধও ত্যাগ হল তাদের। সর্বস্ব ত্যাগ করে গোপীরা ছুটল। কেউ তাদের ধরে রাখতে পারল না। তীব্র স্রোতের অভিমুখে যেভাবে নৌকা ধাবিত হয়, সেইভাবে গোপীরাও কৃষ্ণ অভিমুখে ধাবিত হল। তারা সংসার ধর্ম ত্যাগ করল, লোকত্যাগ করল, স্নেহ ও জাগতিক প্রেমও ত্যাগ করল। তাদের মন প্রাণ জুড়ে কেবল কৃষ্ণ। আর কিছু জানে না তারা, কেবল কৃষ্ণকেই জানে। ভগবানকে পেতে গেলে এভাবেই তো সর্বস্ব ত্যাগ করতে হয়। তা সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের পরীক্ষা করার জন্য বললেন, এই যে তোমরা এই রাতে পরিবার পরিজন সংসার ছেড়ে চলে এলে – এ তোমরা ঠিক করো নি। তোমরা ফিরে যাও।

কৃষ্ণের মুখে এই কথা শুনে গোপীরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। ‘হে নাথ তোমার চরণস্পর্শ যে একবার লাভ করেছে তার কাছে এইসব জাগতিক বন্ধন যে মিছে। আবার যদি আমাদের সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয় সে তো আমাদের চরম দুর্ভাগ্য হবে প্রাণনাথ’। শ্রীকৃষ্ণ এবার হাসলেন, বুঝলেন গোপীদের এই প্রেম নিখাদ, খাঁটি। তাই তিনি বললেন, ‘তোমাদের এই অহৈতুকি প্রেমের প্রতিদান আমি কখনই দিতে পারব না। আমি তোমাদের কাছে চিরঋণী থাকব’। কৃষ্ণ এবার গোপীদের সঙ্গে নৃত্যগীতে নিবিষ্ট হলেন। গোপীরা কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ করে ধন্য হল। কৃষ্ণের নিবিড় সান্নিধ্য কিন্তু গোপীদের মধ্যে জন্ম দিল আত্মম্ভরিতা – তারা মনে করল তারাই অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী যে কৃষ্ণপ্রেমে অবগাহন করতে পেরেছে। এই আত্মম্ভরিতা দূর করার জন্য কৃষ্ণ অকস্মাৎ গোপীদের মধ্য থেকে অন্তর্হিত হলেন। কানহা অদৃশ্য হওয়ায় গোপীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। অন্তরে তীব্র বিরহ জ্বালা নিয়ে তারা কৃষ্ণকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। ওগো নদীতীর, তরুদল তোমরা বলে দাও কৃষ্ণ কোথায়? আমাদের শ্যামকে এনে দাও। নবদূর্বাদলশ্যামকে খুঁজতে খুঁজতে তারা একসময় দেখতে পেল কৃষ্ণের পদচিহ্ন। কৃষ্ণের পদচিহ্নের পাশে পাশে এ কোন রমণীর পায়ের ছাপ! এ তো শ্রীরাধিকা! আমাদের শ্যাম তবে রাধাকে নিয়ে অন্তর্হিত হয়েছেন?

সুধীজন, আসুন, আমরা দেখি, কৃষ্ণ রাধারাণীকে নিয়ে গভীর বনমধ্যে কোথায় হারিয়ে গেলেন? রাধা, পরম সৌভাগ্যবতী রাধা কানহাইয়ার সঙ্গে একাই রাসলীলার আনন্দ উপভোগ করলেন? কৃষ্ণকে একা পেয়ে রাধারও বড় অহংকার হল। আমি তাহলে অন্য গোপীদের চাইতেও সৌভাগ্যবতী যে শ্যামকে একা পেলাম! তাই শ্রীরাধিকা শ্যামকে বললেন, ‘ওগো শ্যাম, আমার প্রাণাধিক, এতখানি হেঁটে এসে আমি বড় ক্লান্ত। আমার পা আর চলছে না। দয়া করে আমাকে তোমার কাঁধে তুলে নাও।’ শ্যাম এবার মুচকি হাসলেন। ‘এসো রাধে’ বলে রাধাকে কোলে তুলে নিলেন। এবার পথিমধ্যে রইল শুধু শ্যামের পদচিহ্ন কিন্তু সে চিহ্ন যেন অধিক গভীর। হবেই তো, কানহা যে রাধাকে কোলে তুলে নিয়েছে! কিন্তু এ সুখ রাধার কপালে সইল কি? কিছুদূর এভাবে যাওয়ার পর শ্যাম আবার অন্তর্হিত হলেন।

‘শ্যাম, শ্যাম, তুমি আমায় ফেলে কোথায় গেলে?’

রাধারাণী এ শোক সইতে পারলেন না। জ্ঞান হারালেন। সেই মূহুর্তে গোপীরা খুঁজতে খুঁজতে রাধাকে একা অচৈতন্য অবস্থায় পেয়ে অবাক হয়ে গেল। রাধার জ্ঞান ফিরলে তারা সকলে মিলে রোদন করতে করতে ফিরে গেল যমুনার তীরে। কৃষ্ণের ধ্যান করতে করতে তারা গাইতে লাগল গোপিকা গীত। হে কৃষ্ণ, আমরা তোমার জন্য সব কিছুই ত্যাগ করলাম। লোক, লাজ, ভয়, কাম, অহংকার – সকলই ত্যাগ করলাম। আমাদের অন্তর জুড়ে শুধু তুমি। তুমি আমাদের হৃদয়ে আছো সখা। আমরা চিরকাল তোমাকে হৃদয়েই অধিষ্ঠিত করে রাখবো। শুধু তুমি দেখা দাও, নাথ, তুমি দেখা দাও। গোপীরা সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণের শরণাগত হল। শরণাগত। শরণাগত। হে প্রভু, তোমাকে ছাড়া আর কিছুই জানি না। তাদের দুচোখে দরদর অশ্রুধারা। অন্তর প্রেমে উদ্বেল।

এবার ভগবানের আসন টলল। কৃষ্ণ গোপীদের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। কি অপূর্ব রূপ তাঁর। রূপ থেকে যিনি গোপীদের অরূপে নিয়ে গেলেন – সেই নবদূর্বাদলশ্যামের গলায় বৈজয়ন্তীফুলের মালা, পরনে পীতবাস। মুখে মধুর হাসি। কানহাইয়াকে দেখে গোপীদের চোখের পলক পড়ে না। তারা নবজীবন লাভ করল। কাম জয় করে হল নিষ্কাম। নেতি নেতি নেতি নেতি ইতি। রাসলীলার মধ্য দিয়ে এভাবে পেল তারা অরূপরতন। রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপরতন খুঁজে পাওয়া। ভগবান কারো একার নন। তিনি সকলের। তাই এক কৃষ্ণ বহু হলেন। রাসলীলা করলেন গোপীদের সঙ্গে।

কে কে ছিলেন এই নৃত্যে? শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমতী রাধা ও গোপীবৃন্দ। শ্রীকৃষ্ণ হলেন স্বয়ং বিষ্ণু অবতার আর শ্রীমতী রাধা তাঁর (শ্রীকৃষ্ণের) ই পরাশক্তি। আর গোপীগণ হলেন সেই মুনি ঋষি গণ যারা অনেক সাধনা করেও ত্রেতাতে শ্রীরামের দর্শন পাননি বলে,তাদের মনে আফসোস ছিল। তাই দ্বাপরে তাঁদের স্বপ্ন পূরণ হলো। এখানে এটা জ্ঞাতব্য যে, ভগবান যখন এ পৃথিবীতে লীলা করেন তিনি কিন্তু তাঁর লীলার সাথীদের দৈবিক শক্তি দ্বারা সৃষ্টি করেন আর লীলা শেষ হলে তারা সবাই পৃথিবী ত্যাগ করেন।

রাসলীলার তাৎপর্য্য:

রাসলীলা ও তিন যোগের সম্পর্ক:
রাসলীলা তিন যোগের সমন্বয়ে গঠিত: জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ ও ভক্তিযোগ।
১. জ্ঞানযোগঃ গোপীবৃন্দের সংগীত যাতে ছিলো পরমাত্মার চরণে নিজেকে বিলীয়মান করার ইচ্ছা তা হলো জ্ঞান যোগের প্রতীক।
২. কর্মযোগঃ শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর সুর ও নিজেদের সংগীতের সাথে তাল মিলিয়ে গোপীরাযে নৃত্য মুদ্রা প্রস্তুত করেছেন, তা হলো কর্মযোগ।
৩. ভক্তিযোগঃ এই সংগীত, নৃত্য, সুর সবকিছুর সমন্বয়ে পরমাত্মা তে লীন হওয়ার যে ভাবের আবেশ হয়েছে, তা হলো ভক্তিযোগ।

রাসলীলার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য্য:

১. রাসলীলা তে আমরা দেখি গোপীগণ চক্রাকারে নাচছেন। এই চক্র হলো মায়াবদ্ধ জীবের ” জন্মমৃত্যু ” চক্র।
২. প্রত্যেক গোপীর সাথে ছিলেন একজন শ্রীকৃষ্ণ। এখানে শ্রীকৃষ্ণের স্বরুপ হলো অন্তর্যামী রুপে। এর মানে, সকল জীবের মাঝে তিনি (পরমাত্মা) আত্মা রুপে বিদ্যমান।এ জগতে সব আত্মা হলেন নারী শক্তির (প্রকৃতির অংশ)। তাই রাসলীলাতে সব গোপী উপস্থিত ছিলেন।
৩. মাঝখানে ছিলেন পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর পরাশক্তি শ্রীমতী রাধারানী। মানে পুরুষ ও প্রকৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন।
৪. আমাদের জীবন মৃত্যু এর মাঝে আমরা বার বার এক ই চক্রে আবর্তিত হতে থাকি। মায়া, মোহ সহ ষড়রিপু আমাদের এক ই বৃত্তে আটকে রাখে। কিন্তু আমাদের সবার আসল গন্তব্য কিন্তু বৃত্তের কেন্দ্রে পৌঁছানো, মানে পরমাত্মায় বিলীন হওয়া। কারণ আমাদের আত্মার প্রকৃত গন্তব্য এটাই।
৫. মায়া আর নিজেদের ষড়রিপুর জাল ছিঁড়তে আমাদের উচিত জ্ঞান কর্ম আর ভক্তির সমন্বয়ে নিজেদের আত্মা থেকে মায়ার পরদা সরিয়ে নেয়া। এই পরদা না সরা অব্দি আমরা পরমাত্মার স্বরুপ বুঝতে পারব না।

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.