যে কারণে আমরা কার্তিক পূজা করি! বিবাহিত না চিরকুমার? ধ্যান ও প্রণাম মন্ত্র।

কার্তিক পূজা হিন্দুদের একটি পুজো। কার্তিক হল হিন্দু যুদ্ধদেবতা। দেবাদিদেব মহাদেব শিব ও দশভুজা দুর্গার আদরের ছোট পুত্র কার্তিক। গণেশ তাঁর দাদা। তবে কোনও কোনও পুরাণে কার্তিককে বড় এবং গণেশকে ছোট পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নিয়ে নানা মতপার্থক্যও আছে। কার্তিক বৈদিক দেবতা নন; তিনি পৌরাণিক দেবতা। প্রাচীন ভারতে সর্বত্র কার্তিক পূজা প্রচলিত ছিল। উত্তর ভারতে ইনি এক প্রাচীন দেবতা রূপে পরিচিত । অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর মতো কার্তিকও একাধিক নামে অভিহিত হন। যেমন – কৃত্তিকাসুত, আম্বিকেয়, নমুচি, স্কন্দ, শিখিধ্বজ, অগ্নিজ, বাহুলেয়, ক্রৌঞ্চারতি, শরজ, তারকারি, শক্তিপাণি, বিশাখ, ষড়ানন, গুহ, ষান্মাতুর, কুমার, সৌরসেন, দেবসেনাপতি ইত্যাদি।ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ ভারতে কার্তিকের পূজা অধিক জনপ্রিয়। তামিল ও মালয়ালম ভাষায় কার্তিক মুরুগান বা মায়ূরী কন্দসামী নামে এবং কন্নড় ও তেলুগু ভাষায় তিনি সুব্রহ্মণ্যম নামে পরিচিত। তামিল বিশ্বাস অনুযায়ী মুরুগান তামিলদেশের (তামিলনাড়ু) রক্ষাকর্তা। দক্ষিণ ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও মরিশাস – যেখানে যেখানে তামিল জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব বিদ্যমান সেখানেই মুরুগানের পূজা অর্থাৎ আমাদের কার্তিক পূজা প্রচলিত। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাংশে কার্তিকেয়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত কথারাগম (সিংহলি ভাষায় “কথারাগম দেবালয়”) মন্দিরে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলায় কার্তিক সংক্রান্তির দিন বা সেই সময়ে কার্তিক পূজার আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়া কাটোয়া ও আরও অনেক পার্শবর্তী অঞ্চলে কার্তিক পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। এছাড়া বাংলার গণিকা সমাজে কার্তিক পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। দুর্গাপূজা সময়ও কার্তিকের পূজা করা হয়। কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সারা বছর ধরেই নানারকমের ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠান লেগেই রয়েছে।আমরা অনেক পূজা সম্পর্কে ভাল করে জানি না। মহাকবি কালিদাস তাঁর ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে ‘কুমার’ তথা কার্তিকের জন্মের পূর্বকথা আলোচনা করেছেন।

কার্তিক ঠাকুর আসলে কে?

কেউ তাঁকে বলে স্কন্দ, কেউ বলে মুরুগন আবার কেউ ডাকে সুব্রহ্মণ্য বলে। তিনি আসলে দেব সেনাপতি, যুদ্ধের দেবতা । আমাদের কাছে জনপ্রিয় কার্তিকেয় বা কার্তিক নামে, শিব ও পার্বতীর পুত্র রূপে। দেবলোকে যেখানেই যুদ্ধ হয় সেখানেই কার্তিকের ডাক পড়ে। পুরাণ অনুসারে হলুদবর্ণের কার্তিকের ছটি মাথা। তাই তাঁর অপর নাম ষড়ানন। যুদ্ধের দেবতা বলে নাকি তাঁর ছটি মাথা। চারিদিক থেকে তাঁর লক্ষ্য অবিচল। পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাত চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। । তাঁর হাতে থাকে বর্শা-তীর-ধনুক। আবার কারো মতে মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম(কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ(লালসা),মদ(অহং), মোহ (আবেগ), মাত্সর্য্য (ঈর্ষা)কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন। এই ষড়রিপু মানুষের জীবনের অগ্রগতির বাধা তাই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে গেলেও কার্তিকের মত সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। পুরাণমতে তিনি তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করে । তাই মা দূর্গার যুদ্ধযাত্রায় সময় এমন শৌর্যবীর্য সম্পন্ন পুত্র সঙ্গে রাখেন। কোনো কোনো মতে রণ-দেবতা কার্তিক হলেন চিরকুমার ব্রহ্মচারী। আবার কোনো কোনো পুরাণ মতে কার্তিকের পত্নী হলেন ইন্দ্রের কন্যা দেবসেনা বা লক্ষ্মীরূপিণী ষষ্ঠী।

আধুনিক বাঙালিদের মধ্যে কার্তিক ঠাকুর পুজো নিয়ে খুব বেশি হইহুল্লোড় হয় না। দুর্গাপুজোর পরেপরেই কিছুদিনের মধ্যেই কার্তিকমাসের সংক্রান্তিতে হয় কার্তিকের পুজো। কোন কোন প্রাচীন পরিবারে ধারাবাহিকভাবে, এবং এক-দুটি বিশেষ অঞ্চলে খুব হইচই করে এই পুজো হয়; কিন্তু সর্বজনীন পুজো হিসাবে কার্তিকপুজো বাঙালি সমাজে এখন আর সেরকম জনপ্রিয় নয়। সেই কমে আসা উৎসাহ থেকেই সম্ভবতঃ মুখে মুখে তৈরি হয়েছে এই ছড়া –

“কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা,
একবার আসেন মায়ের সাথে,
একবার আসেন একলা।”
এটা কিন্তু খুব অন্যায়। একলা কার্তিকই খালি দুবার আসেন নাকি? মা-দুর্গার বাকি ছেলেমেয়েরাও কি আলাদা করে আরেকবার আসেন না? হ্যা আসেন তো। সরস্বতী, গনেশ ও লক্ষী এরা সবাই তো আলাদা আলাদা করেও আসেন।

 

জন্মবৃত্তান্তঃ

কার্তিক,শিব ও পার্বতীর সেই সন্তান যার জন্ম হয়েছিল তারকাসুর বধের জন্য। দক্ষযজ্ঞে সতী তাঁর দেহত্যাগ করলেন এবং তারপর শিব অনন্ত তপস্যায় চলে গেলেন। এইসময়ে ত্রিলোকে তারকাসুর নামে এক অসুর ত্রাসের সৃষ্টি করলো। তারকাসুর বর পেয়েছিল যে একমাত্র শিব-দুর্গার পুত্রই তাঁকে বধ করতে পারবে,সতীর মৃত্যু ঘটেছে এবং শিব তপস্যারত তাই সে নিশ্চিত ছিল যে সে অবধ্য। এদিকে দেবতারা বিপদ বুঝে দেবী মহামায়াকে হিমালয়ের পুত্রী পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করতে অনুরোধ করেন।দেবী পার্বতীর নিরন্তর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব পুত্রলাভের নিমিত্তে পার্বতীর কাছে অবতীর্ন হন এবং শিব-পার্বতীর বিবাহ হয়। কিন্তু শিবের মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই দেবতারা তাঁর দরবারে হাজির হলেন। শিব ও শক্তিরূপিনী পার্বতীর এই যুগ্ম তেজ এক তীব্র অগ্নিপিন্ডের সৃষ্টি করে।পার্বতী নিজে তা নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে শিবের মাধ্যমে অগ্নিদেবকে দান করেন, কিন্তু স্বয়ং অগ্নিদেবও সেই তেজ সহ্য করতে পারেন না এবং অগ্নিপিণ্ডটি গঙ্গানদীতে ফেলে দেন।সেই ভীষণ তেজ গঙ্গার জলকে উত্তপ্ত করে এবং গঙ্গা তা এক বনের মধ্যে নিক্ষেপ করেন।সেই অগ্নিপিণ্ডটি বনবাসিনী ৬ জন কৃত্তিকার গর্ভে ভাগ হয়ে যায় এবং ৬ টি মাথাবিশিষ্ট ষড়ানন কার্তিকের জন্ম হয়।বনের মধ্যে কৃত্তিকার দ্বারা পালিত হওয়ায় এই শিশুর নাম হয় কার্তিক। পরে পার্বতী অতি সুন্দর ও লাবণ্যময় কার্তিকের জন্মসংবাদ পেয়ে তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসেন। বাল্যবয়সেই তাঁর বীরত্বের জন্য তিনি দেবসেনাপতি নিযুক্ত হন। এরপর ইন্দ্রদেবের ও দেবসেনাগনের সাহায্যে তিনি তারকাসুরের সাথে মহাযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং যুদ্ধের ষষ্ঠদিনে তারকাসুরকে বধ করেন।মৃত্যুমুখে তারকাসুর বর চেয়ে নেন সর্বদা কার্তিকের সঙ্গে থাকার,তাই যুদ্ধে যে দুটিরূপে তারকাসুর অবতীর্ণ হয়েছিলেন- ময়ুর এবং মোরগরূপে সেভাবেই ময়ুরবাহনরূপে সর্বদা কার্তিকের সাথেই থেকে যান এবং মোরগটি কার্তিকের তারকাসুর বধের চিহ্ন হিসেবে পতাকাতে থেকে যায়।

আরও একটি উৎস অনুযায়ী শিবের অন্য রূপ রুদ্র অগ্নির সঙ্গে এক হওয়ার পরে মহাদেব সপ্তর্ষিপত্নীদের রূপে কামমোহিত হয়ে পড়েন। তাঁকে তুষ্ট করতে স্বাহা অরুন্ধতী ছাড়া বাকি ছয় সপ্তর্ষিপত্নী যথা সম্ভূতি, অনসূয়া, ক্ষমা, সন্নতি, প্রীতি ও লজ্জা ছদ্মবেশে ছ’বার অগ্নির সঙ্গে মিলিত হন। এর ফলে ছ’মাথা, দ্বাদশ বাহুযুক্ত যে কুমারের জন্ম হয় তিনি কার্তিক। আবার অন্য মতে হর-পার্বতীর মিলনের ফলে সৃষ্ট তেজধারা পার্বতীর গর্ভ অতিক্রম করে ছ’বার পৃথিবীতে পড়ে। পার্বতী সেই তেজঃপুঞ্জকে এক করলে ছ’মাথা ও দ্বাদশ হাতযুক্ত এক বিক্রম কুমারের জন্ম হয়।

ময়ূর কেন বাহন

অষ্টম শতকের ভাস্কর্য কার্তিকের বাহন আলস্যবিহীন ময়ুর। অসাধারণ কর্মতৎপর এই পক্ষী খুবই সুন্দর দেখতে। ময়ূরের পায়ে একটি সাপ অর্থাত অহংবোধ ও কামনা বাসনা বলি দিয়ে তিনি যুদ্ধ করতে ব্যস্ত। ময়ূর অত্যন্ত সজাগ এবং কর্মচঞ্চল পাখী । সৈনিক কার্তিকের সবগুণগুলি সে বহন করে । ময়ূর খুব সামান্যই নিদ্রা যায়। সর্বদা সতর্ক। আলস্যহীন। ময়ুরের স্বজনপ্রীতি লক্ষণীয়। সৈনিক পুরুষ ময়ূরের মতো অনলস, কর্মকুশল এবং লোকপ্রিয় হবেন তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া, ময়ূর মেঘ দেখলে যেমন আনন্দে পেখম তুলে নৃত্য করে, তেমনই ধীর ব্যক্তি শত বিপদেও উৎফুল্ল থাকবেন। সৌন্দর্য ও শৌর্য – কার্তিকেয়ের এই দুই বৈশিষ্ট্যই তাঁর বাহন ময়ূরের মধ্যে বিদ্যমান। সম্ভবত এই সব কারণেই কার্তিকের বাহন ময়ূর।

নাম কার্তিক কেন

কৃত্তিকা নক্ষত্রে তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং ছয় কৃত্তিকার দ্বারা তিনি পুত্ররূপে গৃহীত ও প্রতিপালিত হন বলে তাঁর নাম কার্তিকেয় বা কার্তিক। তাঁর আরো অনেক নাম আছে যেমন গুহ, পাবকি, মহাসেন, ষন্মুখ,কুমার, কুমারেশ, গাঙ্গেয়, বিশাখ, মহাসেন, কুক্কুটধ্বজ, নৈগমেয়। যখন তিনি গঙ্গার পুত্র, তখন তিনি কুমার | পার্বতীর পুত্র হলে স্কন্ধ | কৃত্তিকা বা মহাদেবতনয় হলে কার্তিকেয় | অগ্নিপুত্র হলে তাঁর পরিচয় গুহা।

কেনো আমরা কার্তিকের পূজা করি

ব্রহ্মার বরে মহাবলী তারকাসুরের নিধনের জন্যই নাকি অমিত বিক্রম যোদ্ধা কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। কেউ বধ করতে পারছিলনা তারকাসুরকে। তার অত্যাচারে দেবকুল অতিষ্ঠ । আর দৈববলে অজেয় শক্তি সম্পন্ন এই দেবশিশু কার্তিকেয় তারকাসুর নিধন করেছিলেন । আর এই তারকাসুর নিধন করে দেবকুলে কার্তিক গেলেন দেবসেনাপতি। তাই কার্তিকের পুজো হয় মহাসমারোহে। দেবতারূপে কার্তিক একসময়ে সারা ভারতীয় উপমহাদেশেই খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় পুরাণগুলির মধ্যে স্কন্দ পুরাণে কার্তিকের বিষয়ে সবিস্তারে লেখা আছে। তাছাড়াও মহাভারতে এবং সঙ্গম তামিল সাহিত্যে কার্তিকের নানা বর্ণনা রয়েছে। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে বারোটি হাত যুক্ত কার্তিকের একটি অভিনব মূর্তি রক্ষিত আছে।

পুত্রসন্তান কামনাঃ

কার্তিক হিন্দুদের উর্বরতার দেবতা।কার্তিক পূজার মাধ্যমে দম্পতিরা সন্তান প্রার্থনা করে থাকেন৷ কথিত আছে দেবকী কার্তিকের ব্রত করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে পুত্ররূপে লাভ করেছিলেন ৷ কথায় বলে কার্তিকের মতো চেহারা অর্থাৎ কার্তিকের দেহ আকৃতি অত্যন্ত সুন্দর ও বলিষ্ঠ এই কারণে কার্তিক পূজার মাধ্যমে দম্পতিরা সুন্দর ও বলিষ্ঠ চেহারার সন্তান প্রার্থনা করে থাকেন ৷ কার্তিকের পূজা খালি সন্তানপ্রাপ্তির পূজা নয়,এ পুরানকথার সাপেক্ষে তৈরী স্থানীয় লোকাচার মাত্র।কথিত আছে কার্তিক ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর পুত্রীদের বিবাহ করেন। ব্রহ্মা ও সাবিত্রীর মেয়ে দেবী ষষ্ঠী পুরাণমতে কার্তিকের স্ত্রী,যিনি জন্ম ও জন্মসুত্রের দেবী। সেই কারণেই হয়তো বঙ্গদেশে সন্তানলাভের আশায় কার্তিক পূজা করা হয়। কার্তিক দেবতাদের সেনাপতি তিনি অসীম শক্তিধর দেবতা এজন্য তাকে রক্ষা কর্তা হিসেবে পূজা করা হয় ৷কার্তিক নম্র ও বিনয়ী স্বভাবের দেবতা৷ কিন্তু সমাজের নেই অন্যায় ও অবিচার নির্মূলে তিনি অবিচল যোদ্ধা৷ আমরা কার্তিকের ন্যায় প্রতিষ্ঠার আদর্শ অনুসরণে নীতিবান হতে পারি৷ তাকে অনুসরণ করে বিনয়ী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারি এবং আদর্শ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি ৷আমাদের সকলকেই কার্তিকের মতন নম্র ও বিনয়ী হওয়া উচিত এবং অন্যায় অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত৷

কার্তিকের মত স্বামী কামনাঃ

বাংলায় কার্তিক পুজো হয় কার্তিক সংক্রান্তিতে। অর্থাত্‍ কার্তিক মাসের শেষ দিনে। সন্তানহীন দম্পতিরাই তাঁর পুজোর আয়োজন করে থাকেন এখানে। পাশেই ওড়িশায় আবার প্রচলিত ভিন্ন রীতি। সেখানে বিজয়া দশমীর পরের পূর্ণিমায় অর্থাত্‍ আমাদের যেটা কোজাগরী পূর্ণিমা সেদিন ওখানে কুমার পূর্ণিমা | কুমারী মেয়েরা পুজো করে কার্তিকের। তাঁর মতো স্বামী লাভ করতে। বাঙালি মেয়েরা প্রার্থনা করে শিবের মতো স্বামী। ওড়িয়াকন্যাদের পছন্দ কুমার কার্তিকেয়। হিমাচল প্রদেশের চাম্বাতেও পূজিত হন কুমার কার্তিকেয়।

৬ ও কার্তিকঃ

কার্তিকের ৬টা মাথা মানুষের মধ্যে ৬ টি রিপু ও তাঁর দমনের প্রতীক,বাহন ময়ুর সৌন্দর্য্য ও দক্ষতার প্রতীক। ময়ুরের নখাগ্রের সাপ,হিংসা দমনের প্রতীক। অস্ত্রসজ্জিত হাত শৌর্য্যের প্রতীক। কার্তিকের জীবন ও রূপের সাথে “৬” সংখ্যাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ আছে। ৬ জন কৃত্তিকা দ্বারা পালিত, একই সঙ্গে পালনকারী ৬ জন কৃত্তিকা্র স্তন্য পান করার ব্যগ্রতায় কুমারের ৬ টি মুখ তৈরি হয়, ৬তম দিনে তারকাসুর বধ এবং দেবী ষষ্ঠীকে বিবাহ। আসলে ৬ সংখ্যা দ্বারা হিন্দু পুরাণে মানুষের মন-কে বর্ণনা করা হয়। আমাদের মনের ৬ টি স্তর- যুক্তি,আবেগ,চিন্তা,জ্ঞান,বুদ্ধি,সচেতনতা।আর এদের ৬টি শত্রু হলো ৬টি রিপু—কাম,ক্রোধ,লোভ,মোহ,মদ,মাতশর্য্য।আমাদের প্রধান ৫টি ইন্দ্রিয় এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হলো স্বউপলব্ধি।মানে ৫+১=৬টি ইন্দ্রিয়রূপী অস্ত্র দ্বারা আমরা ৬টি রিপুকে দমন করতে পারি আর মনের ৬টি গুনকে জাগৃত করতে পারি।আর মানুষের জীবনের এটাই যুদ্ধ—৬টি রিপুর সাথে ৬টি চেতনার।তাই এই যুদ্ধের প্রতীকী দেবতা হলেন ষড়ানন কার্তিক,যিনি আমাদের জয়যুক্ত করেন।

নবান্ন ও কার্তিক পূজাঃ

নবান্ন উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন প্রথা। হিন্দুবিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্নপ্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দুরা পার্বণবিধি অনুযায়ী নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। এই নবান্নকে কেন্দ্র করে কার্তিক পুজো হয়।

বিবাহিত না চিরকুমারঃ

কথিত আছে, দুর্গা তনয় কার্তিক নাকি অবিবাহিত ছিলেন। সেই নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। সব থেকে বেশি শোনা যায়, মূলত তাঁর প্রেম ও মাতূভক্তির কারণটি। একদিন কার্তিক দানবকুলকে ধ্বংস করে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে চোখ পড়ে এক দেবকন্যার দিকে। কার্তিক সেই তরুণীর সঙ্গে পরিচয় করে জানতে পারেন, তাঁর নাম ঊষা। রূপবতী দেবকন্যার প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন কার্তিক। দিয়ে বসেন বিয়ের প্রস্তাব। এরপর ঊষাকে সঙ্গে নিয়ে কৈলাশের কাছে পৌঁছন কার্তিক। সেখানে গিয়ে তাঁর উপলদ্ধি হয়, বিয়ের আগে মায়ের অনুমতি দরকার। অতত্রব ঊষাকে একটি ধানখেতে দাঁড় করিয়ে মা দুর্গার কাছে অনুমতি নিতে যান কার্তিক। দেবী দুর্গা এককথাতে অনুমতিও দিয়ে দেন বিয়ের জন্য। এরপর বর সেজে ধান খেতের উদ্দেশে রওনা দেন কার্তিক। হঠাত্‍ মনে পড়ে যায়, মাকে তো প্রনামই করা হয়নি। অতত্রব ফের যান মায়ের কাছে। মায়ের কাছে গিয়েই চক্ষুছানাবড়া কার্তিকের। দেখেন, রান্নাঘরে বসে মা তাড়াহুড়ো করে খেতে বসেছেন। কেন এত তাড়াহুড়ো করে মা খাচ্ছেন? কৌতুহলের বসে কার্তিক প্রশ্ন করে দেবী দুর্গাকে। উত্তরে দুর্গা বলেন, পুত্রবধূ বাড়িতে আসার পর যদি তাঁকে খেতে আর না দেন! সেই ভয়েই আগে থেকে খেতে বসে গিয়েছেন তিনি। একথা শুনে চোখ ভিজে যায় কার্তিকের। সেই মুহুর্তেই বিয়েই চিন্তা বাতিল করেন কার্তিক। এদিকে কার্তিকের প্রতিজ্ঞার কথা শুনতে পেয়ে লজ্জাতে ধান খেতেই লুকিয়ে পড়েন ঊষা। কার্তিক মাসে ধানের যে শিষ বের হয়, অনেকেই বলেন সেই শিষ নাকি ঊষা।

অনেক উৎস মতে অনেকেই বলে থাকেন কার্তিক ঠাকুর চিরকুমার। আসলেই তা নয়। কার্তিকের জন্ম অমাবস্যা তিথিতে। একটু বড় হতেই দেবতারা তাঁকে জানালেন তাঁর বংশপরিচয়। ষষ্ঠদিনে তাঁর দেবসেনাপতিত্বে অভিষেক এবং দেবসেনার আধিপত্য লাভ, এবং পাঠালেন তারকাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে। নিয়মমতো তারকাসুর বধও হলেন কার্তিকের হাতে। শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতেই দেবসেনার সঙ্গে কার্ত্তিকের বিবাহ। একমতে তাঁর পত্নী ‘দেবসেনা’ হলেন ব্রহ্মার কন্যা। মতান্তরে তিনি আবার ইন্দ্রের কন্যা ৷ তারকাসুরকে বধ করেছিলেন কার্তিক। তখন কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ইন্দ্র তাঁর মেয়ে দেবসেনার সঙ্গে বিয়ে দিলেন শিবপুত্রের। দেখা যায় বিভিন্ন পুরাণেই কথিত রয়েছে দেবতা ও অসুরদের প্রচণ্ড সংগ্রাম এবং দেবতাদের পরাজয়ের পটভূমিকায় শিব-পার্বতীর পুত্ররূপে কার্ত্তিকের জন্ম হয়েছিল। আবার কার্ত্তিকের জন্ম-উপাখ্যানটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কার্ত্তিকের জন্মের পিছনে ছিল শিব-পার্বতীর কঠোর তপস্যা। সন্তান আসবে পিতা-মাতার সংযম ও তপস্যার সেতুপথে-এটাই প্রাচীন ভারতীয় দাম্পত্য জীবনের মূল দর্শন। প্রেম কী, তা বোঝার আগেই শুরু হল তাঁর দাম্পত্য। কাত্তির্কের স্ত্রীর নাম দেবসেনা। সেকারণেও তিনি ‘দেবসেনাপতি’ আবার দেবসেনাবাহিনীর নায়কত্বের জন্য ও তিনি ‘দেবসেনাপতি’ নামে পরিচিত।

কার্তিক বড় হ্যাংলা! হ্যাংলা কেন? না, ওই যে ছড়া কেটে বলি আমরা- একবার আসেন মায়ের সঙ্গে, একবার আসেন একলা! এই ঠাকুরটি হ্যাংলা অন্য কারণে। আসলে ছোট থেকে তিনি বড়ই ভালবাসার কাঙাল! এক স্ত্রী থাকার পরেও সেই ভালবাসা খুঁজতে যে কারণে ছদ্মবেশ ধরতে হয় তাঁকে। আদায় করে নিতে হয় কাঙ্ক্ষিত রমণীর প্রেম। দেখে নিই কি সেই প্রেম-

বিয়ের পর স্ত্রী দেবসেনার সঙ্গে নিয়ে কৈলাসে বসবাস শুরু করেন কার্তিক। মা, বাবা আর ভাই গণেশের সঙ্গে সুখে দিন কাটছিল। কিন্তু, সেই সুখের দিনে গ্রহণ এল। ভাই গণেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মুখে পড়তে হল কার্তিককে৷ প্রতিযোগিতার বিষয় – দুই ভায়ের মধ্যে কে আগে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারবে৷ তা শুনে বাহন ময়ূরে চড়ে সারা পৃথিবী ঘুরতে বেড়িয়ে পড়েন কার্তিক৷ কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন তার আগেই বিজয়ীর সম্মান পেয়ে গিয়েছেন গণেশ কারণ তিনি বাবা-মাকেই পৃথিবীজ্ঞানে তাঁদের প্রদক্ষিণ করে এই কাজটি সেরেফেলেছেন। সকলেই প্রশংসা করছেন তাঁর বুদ্ধির৷ এরপর একরাশ অভিমান নিয়ে কৈলাস ত্যাগ করে স্ত্রী দেবসেনাকে নিয়ে চলে এলেন দক্ষিণ ভারতে। বসতি করলেন পাহাড়ে। উপজাতি তাঁকে বরণ করে নিল সাদরে। ময়ূরবাহন বা মুরুগন বলে জানাল শ্রদ্ধাও! কিন্তু, ভালবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কার্তিকের মন থেকে দূর হল না। তখনও যদিও তিনি জানতেন না, প্রেম এসে ধরা দিতে চলেছে তাঁর বাহুবন্ধনে। দক্ষিণ ভারতের এই পাহাড়েই সার্থক হবে তাঁর প্রেমের কামনা।

কার্তিক তাই কিছুটা মনমরা হয়েই থাকেন। ঘুরে বেড়ান ইতিউতি। এমন সময়ে একদিন তিনি দেখলেন, এক পাহাড়ি ক্ষেতে শস্য পাহারা দিচ্ছে একটি কালো মেয়ে! যতই কালো হোক, কার্তিক তুমুল ভাবে তার প্রেমে পড়লেন। এক বৃদ্ধের ছদ্মবেশে গিয়ে নাম জানতে চাইলেন, জানতে চাইলেন পরিচয়। শুনলেন, সে সেখানকার উপজাতি রাজার মেয়ে। তার নাম বল্লী। এবার কার্তিক চাইলেন বল্লীকে বিয়ে করতে। সে কথা বলতেই বল্লী রেগে আগুন হলেন! তিনি সদ্য যুবতী, তাঁর কেন এক বৃদ্ধকে মনে ধরবে! বিপদ দেখে কার্তিক তখন স্মরণ করলেন গণেশকে। গণেশও ভাইয়ের মনের কথা ভেবে এক মত্ত হস্তীর রূপ ধরে আটকে দাঁড়ালেন বল্লীর রাস্তা। বল্লীর আর উপায় নেই! মত্ত হাতির ভয়ে তিনি জড়িয়ে ধরলেন সেই বৃদ্ধকে। ভয়ে তাঁর দু’চোখ বোজা! সেই অবস্থাতেও মরিয়া কার্তিকের দয়া হল না। তিনি আদায় করে নিলেন প্রতিশ্রুতি- হাতিটাকে তাড়াতে পারলে বল্লী তাঁকে বিয়ে করবেন! নয় তো দু’জনেই মরবেন! রাজি হতে তাই বাধ্য হলেন বল্লী। যখন তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন সেই বৃদ্ধের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক সুপুরুষ যুবক। এর পর আর বিয়েতে আপত্তি থাকার কথা নয়। বিয়ে হলও ধুমধাম করে। এবং, বল্লীর সঙ্গে দাম্পত্য আর প্রেম পূর্ণ ভাবে উপভোগ করার জন্য দক্ষিণ ভারতের ছয়টি স্থানে ছয়টি শস্ত্রাগার নির্মাণ করলেন কার্তিক! যেখানে তৃপ্ত হবে তাঁর অস্ত্রচর্চা আর প্রেমচর্চা- দুই! সেই ছয়টি শস্ত্রাগার আজ ভারতের সবচেয়ে পবিত্র কার্তিক মন্দিরে পরিণত হয়েছে।

কাটোয়া-বাঁশবেড়িয়া-চুঁচুড়ায় ভিন্ন ভিন্ন নামে কার্তিক পুজোঃ

কাটোয়ার ন্যাংটা কার্তিকঃ

চন্দননগর যেমন জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য বিখ্যাত, কাটোয়াও তেমনি বিখ্যাত কার্তিক পুজোর জন্য। কাটোয়ার সর্বজনীন কার্তিকপুজোর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কার্তিকের লড়াই। এখানকার অধিকাংশ বারোয়ারি পুজোর প্যান্ডেল হয় পুরো রাস্তা জুড়ে। বারবার গাড়িতে ওঠানো নামানো অসুবিধাজনক হওয়ায় মূর্তিগুলিকে লোহার তৈরি চারচাকা গাড়ির সমতল বেদির ওপর রাখা হয়। কার্তিক পুজোর আগের রাতে শহরের সবকটি বারোয়ারি পুজোর ঠাকুর শহর পরিক্রমার বের হয়। সঙ্গে থাকে ঢাক-ঢোল, তাসা-পার্টি। শোভাযাত্রা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। এখানকার ন্যাংটা কার্তিক বিখ্যাত।

চুঁচুড়ার জামাই কার্তিকঃ

বিভিন্ন আঙ্গিকে কার্তিক পুজো হয় চুঁচুড়ায়। আবার কোনও কার্তিকের নাম বাবু কার্তিক। বাঁশবেড়িয়া-চুঁচুড়া অঞ্চলের কার্তিক পুজোর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে কিছু জনশ্রুতি রয়েছে। ষণ্ডেশ্বরতলায় বুড়োশিবের প্রতিষ্ঠা করেন চাঁদ সদাগর এবং ষণ্ডেশ্বরতলায় কার্তিকপুজো করেন বুড়োশিব শঙ্কর। এখানে অর্জুন কার্তিক থেকে জামাই কার্তিকের দেখা মেলে।

 

চুঁচুড়ায় কার্তিকের সঙ্গে শিব ও গণেশঃ

কার্তিক পুজো সঙ্গে অনেক চাওয়া-পাওয় এবং হিসেব-নিকেশ জড়িয়ে আছে। মূলত বণিক সম্প্রদায়ের কারণেই কেন্দ্রীভূত হয় কার্তিক পুজো। সঙ্গে শিব ও গণেশেরও দেখা মেলে।

বাঁশবেড়িয়ার লড়াই কার্তিকঃ

কোনও কার্তিকের নাম আবার লড়াই কার্তিক। এই মূর্তি মহিষাসুর বধের আঙ্গিকে করা হয়। লড়াই কার্তিকের খোঁজ পাওয়া যায় চুঁচুড়ার গোলাবাগান এবং কনকশালীতেও।

পশ্চিমবঙ্গে কার্তিক পূজা

কার্তিক ঠাকুরের সাথে ছয় সংখ্যা জড়িয়ে আছে৷ সেজন্য হয়ত স্ত্রী ষষ্ঠীর সাথে তার মিল৷ তিনি বাচ্চা বড় না হওয়া অব্দি তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন ৷ তার কৃপা পেলে পুত্রলাভ , ধনলাভ হয় ৷ সেজন্য বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনও সন্তান আসেনি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা হয় । যা প্রজাপতি বিস্কুট সিনেমাতে ও দেখানো হয়েছে। সুঠাম গড়নের ল্যাংটো কাটোয়ার কার্তিক লড়াই খুব বিখ্যাত। কাটোয়ার কার্তিক পুজো বিখ্যাত বলেই এখানে এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ‘কার্তিক লড়াই’ বলে মূল আকর্ষণ ছিল ‘থাকা’। কার্তিক পুজোর দিন পথে কাটোয়ায় এক বড়সড় মিছিল নামে ।পুরাণের কাহিনি অনুসারে পিরামিডের আদলে তৈরি বাঁশের কাঠামোর ধাপে ধাপে পুতুল সাজিয়ে তা ফুটিয়ে তোলা হত। বিসর্জনের দিন রাতভর চলত শোভাযাত্রা। শোনা যায়, এক সময়ে ভাগীরথীর তীরে চুনারিপাড়ায় বারাঙ্গনাদের আস্তানা ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য কাটোয়ায় আসতেন বিভিন্ন এলাকার বাবু সম্প্রদায়ের মানুষ। ওই চুনারিপাড়ায় ঠাঁই নিতেন তাঁরা। সেখান থেকেই কার্তিকপুজোর উৎপত্তি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য শহরের নামী ও গুণী মানুষজনের হাত ধরে কার্তিকপুজো প্রসার পায়। কার্তিকপুজো নিয়ে চর্চা লেগেই থাকত। কোন ক্লাবের ঠাকুর কত বড়ো বা কার শোভাযাত্রা কত মানুষ টানতে পারে এই নিয়ে রেষারাষি ছিল তুঙ্গে। পরে এটি হয়ে দাঁড়ায় কাটোয়ার ‘কার্তিক লড়াই’। এই লড়াই কার্তিকপুজোকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। হালিশহরের’জ্যাংড়া কার্তিক’ ও ‘ধুমো কার্তিক’ পূজা ও খুব বিখ্যাত। এভাবেই যুদ্ধ আর সন্তান উৎপাদন- দুইয়ের অনুষঙ্গেই কার্তিককে স্মরণ করে বাঙালি।

পাল বাড়ির ঐতিহাসিক তিন কার্তিক

বর্ধমান(পশ্চিম বর্ধমান) জেলায় গৌরবাজার ( পান্ডবেশ্বর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে) নামে এক গ্রামে বিগত ১৬৬ বছর ধরে এই পুজো হয়ে আসছে বলে অনুমান। এই পুজোর বিশেষত্ত হল তিনটি কার্তিক, বড় কার্তিক, মেজো কার্তিক, ছোটো কার্তিক। অনেকের কাছে বিষয়টা অদ্ভূত এবং কৌতূহলের, যে পুজো হলে তো একটি কার্তিক এর হবে এখানে একই ঠাকুরের তিনটি মূর্তি কেনো?,উত্তর লুকিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। বিঘা বিঘা জমি,বর্ধমান রাজাদের তত্ত্বাবধানে পাল দের জমিদারি তখন রমরমা। সারা গ্রাম থেকে আশে পাশের গ্রামে পালে দের জমিদারি ছিল বিশেষ। জানা যায় আনুমানিক ১৮৫৩ সাল নাগাদ জমিদার জয় নারায়ণ পাল, শ্যামপাল, লক্ষী নারায়ণ পাল এর কোনো সন্তান জন্ম না হওয়ায়, তারা চরম চিন্তায় ছিলেন। অনেক উপায় অবলম্বন করেও কোনও সুরাহা হয় নি। তখন এক রাত্রে স্বপন আদেশে জয় নারায়ণ পাল দেখেন যে নিস্বারথ কার্তিক পুজো করতে হবে তাদের তিন ভাই কে। তবেই তাদের শুন্য কোল আলো হবে। তাই তারা তিন ভাই মিলে অভিনব ভাবে মন্দির তৈরি করে একসাথে তিনটি কার্তিক পূজা করা শুরু করেন। এবং তারপরে আনুমানিক ১৮৫৭ সালে লক্ষী নারায়ণ পালের এক পুত্র সন্তান লাভ হয় ধজাধারি পাল, এবং আরো দুই ভাই এর একটি করে কন্যা সন্তান লাভ হয়। সেই সৌভাগ্যবসত পরম্পরা অনুযায়ী পুজো করে আসছেন বংশধরেরা এবং এই সন্তান না হওয়ার অন্ধকার এই বংশকে আর এসে ঘিরে ধরেনি। এই পুজো আজও বর্তমান।

দক্ষিণ ভারত (তামিল)

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উত্তর ভারতে কার্তিকের প্রভাব কমে আসে। আরাধ্য দেবতা রূপে কার্তিক উত্তর ভারতীয়দের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় দক্ষিণ ভারতে। তামিলদের কাছে তিনি মুরুগন নামে, আর অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকে তনি সুব্রহ্মণ্য নামের পুজিত হন। তামিলদের কাছে মুরুগন প্রধান আরাধ্য দেবতাদের মধ্যে একজন। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে যেখানেই তামিলদের সংখ্যা বেশি, যেমন শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস- সেখানেই মুরুগন পরিচিত এবং সাড়ম্বরে পুজিত হন। সেখানে তার অসংখ্য মন্দির আছে।তবে তামিলনাড়ুর ৬ টি মন্দির খুব পবিত্র। সেগুলি হল-

১। স্বামীমালাই মুরুগান মন্দির
২। পালানী মুরুগান মন্দির
৩। থিরুচেন্দুর মুরুগান মন্দির
৪। থিরুপ্পারামকুমারাম মুরুগান মন্দির
৫। থিরুথানি মুরুগান মন্দির
৬। পাঝামুদিরচোলাই মুরুগান মন্দির ।

কেন আজও ন্যাংটো কার্তিকের পুজো হয় কাটোয়ায়?

বারবিলাসিনীদের কার্তিক পুজো আর এককালে শহুরে জমিদারবাবুদের মধ্যে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা থেকেই কাটোয়ায় কার্তিক লড়াইয়ের পরম্পরা শুরু। ভাগীরথীর তীরবর্তী কাটোয়া শহর ও তার আশপাশের এলাকায় আজও ধুমধাম করে কার্তিক পুজো হয়। স্থানীয় ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মঙ্গলকোটের প্রত্নক্ষেত্র থেকে যে কার্তিক মূর্তির অস্তিত্ব মিলেছে তা গুপ্তযুগের নির্দশন। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই চলছে দেবসেনাপতির আরাধনা। কাটোয়ার গঙ্গাতীরে বর্তমান হরিসভাপাড়ার আগে নাম ছিল চুনুরিপাড়া। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই পাড়াতেই গড়ে উঠেছিল বারবনিতাদের পল্লি। তাঁদের আশ্রয়দাতা ছিলেন তখনকার জমিদার, বাবু ও বণিকরা। চুনুরিপাড়ার বারবনিতারা মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার আশায় শুরু করছিল ন্যাংটো কার্তিকের পুজো। সন্তানের আশায় এখনও যে শিশুকার্তিকের পুজো করার রীতি রয়েছে। কাটোয়া শহরে এখনও ন্যাংটো কার্তিকের পুজোর চল রয়েছে। এই পুজোকে কেন্দ্র করেই জমিদারদের ও বণিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হত। কালক্রমে সেই প্রতিযোগিতাই কার্তিক লড়াই নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠে।

কার্তিকের মন্ত্র ও পরিচিতি

কার্ত্তিক দেবতার ধ্যান :

ওঁ কার্ত্তিকেয়ং মহাভাগং ময়ুরোপরিসংস্থিতম্।
তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভং শক্তিহস্তং বরপ্রদম্।।
দ্বিভুজং শক্রহন্তারং নানালঙ্কারভূষিতম্।
প্রসন্নবদনং দেবং কুমারং পুত্রদায়কম্।।
অনুবাদ : কার্ত্তিকদেব মহাভাগ, ময়ূরের উপর তিনি উপবিষ্ট। তপ্ত স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল তাঁর বর্ণ। তাঁর দুটি হাতে শক্তি নামক অস্ত্র। তিনি নানা অংলকারে ভূষিত। তিনি শত্রু হত্যাকারী। প্রসন্ন হাস্যোজ্জ্বল তাঁর মুখ।

 

প্রণাম মন্ত্র :

ওঁ কার্ত্তিকের মহাভাগ দৈত্যদর্পনিসূদন।
প্রণোতোহং মহাবাহো নমস্তে শিখিবাহন।
রুদ্রপুত্র নমস্ত্তভ্যং শক্তিহস্ত বরপ্রদ।
ষান্মাতুর মহাভাগ তারকান্তকর প্রভো।
মহাতপস্বী ভগবান্ পিতুর্মাতুঃ প্রিয় সদা।
দেবানাং যজ্ঞরক্ষার্থং জাতস্ত্বং গিরিশিখরে।
শৈলাত্মজায়াং ভবতে তুভ্যং নিত্যং নমো নমঃ।
 

অনুবাদ : হে মহাভাগ, দৈত্যদলনকারী কার্ত্তিক দেব তোমায় প্রণাম করি। হে মহাবাহু, ময়ূর বাহন, তোমাকে নমস্কার। হে রুদ্রের (শিব) পুত্র, শক্তি নামক অস্ত্র তোমার হাতে। তুমি বর প্রদান কর। ছয়। কৃত্তিকা তোমার ধাত্রীমাতা। জনক-জননী প্রিয় হে মহাভাগ, হে ভগবান, তারকাসুর বিনাশক, হে মহাতপস্বী প্রভু তোমাকে প্রণাম। দেবতাদের যজ্ঞ রক্ষার জন্য পর্তবতের চূড়ায় তুমি জন্মগ্রহণ করেছ। হে পর্বতী দেবীর পুত্র তোমাকে সতত প্রণাম করি।

কার্তিক পূজা নিয়ে বিভিন্ন মতামতঃ

১. কার্তিক ব্রত:

পূর্ববঙ্গে সন্তানবতী মায়েরা পালন করতেন এই ব্রত; এখনও এপার-ওপার বাংলার বহু নারী এই ব্রত করেন কার্তিক সংক্রান্তিতে। ব্রতের প্রধান অঙ্গ কার্তিকের প্রতিমা পুজো। সায়ংকালে শুরু হয় পুজো — চার প্রহরে চারবার পুজো আর কথা শ্রবণ; অশক্ত হলে একবারই পুজো এবং প্রাতঃকালে বিসর্জন, যদিও পূর্ববঙ্গে প্রতিমা জলে দেওয়ার নিয়ম নেই। লোকমানসে মূলত সন্তান কামনায়, বিশেষত পুত্র সন্তান কামনায় বন্ধ্যা নারীরা ভক্তিভরে এই দেবতার পুজো করেন। কার্তিকের একাধিক মূর্তি পূজিত হয়। পুজোর শেষে সন্তানহীনা নারী এক-একটি কার্তিক মূর্তি কোলে নিয়ে ঘরে খিল এঁটে দেয়। অনেক সময় সংক্রান্তির আগের রাতে পাড়ার অত্যুত্‍সাহী যুবকেরা নৈশ গোপনতায় নবদম্পতির দুয়ারে কার্তিকের মূর্তি রেখে আসে; উদ্দেশ্য অপুত্রক দম্পতিকে কার্তিক পুজোয় বাধ্য করানো। শুদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে দেখা যায় কার্তিক ‘চোরের দেবতা’ ইমেজে পূজিত হচ্ছেন। ‘কথাসরিতসাগর’-এর কার্তিকও চোরের দেবতারূপে চিহ্নিত। লোকবিশ্বাস, কার্তিক সিঁধ কাটার বিভিন্ন পদ্ধতির উদ্ভাবক। বাংলার অনেক অঞ্চলে বারবণিতাদের হাত ধরে কার্তিক পুজোর প্রচলন হয়েছে। এই কার্তিক পুজোর মনস্তাত্ত্বিক কারণ তিনটি– প্রথম, ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’ — এরকম একটা হৃদয়ের ব্যাকুলতা; দ্বিতীয়, অনাস্বাদিত মাতৃত্বের স্বাদ মেটাতে ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’র প্রচেষ্টা। তৃতীয়, কার্তিককে ভ্রূণের দেবতারূপে মান্যতা দিয়ে আকস্মিক ভ্রূণ উত্‍পাদন বন্ধ করতে বারবণিতারা কার্তিক পুজো করেন। লোকসমাজে কার্তিক শস্য দেবতাদের অন্যতম। তাই বাংলার অনেক অঞ্চলে কৃষি দেবতাকে এইদিন পুজো করা হয়। সারারাত ধরে গাওয়া হয় গান। ফসলের কীটশত্রু, জীবজন্তু তাড়িয়ে দেওয়াই গানের মূল বিষয়। পুজোর পর মূর্তিটি বিসর্জন না দিয়ে শস্যক্ষেত্রে রেখে দেওয়া হয় শস্য রক্ষাকর্তা হিসাবে। কার্তিক ব্রতে কার্তিক প্রতিমার পাশে রাখা হয় ‘হালা’। হালা হচ্ছে মাটির সরায় মাটিতে লাগানো নানান শস্য চারা। সম্ভবত কার্তিক কৃষি দেবতা বলেই এই সরার শস্যক্ষেত্র। অনেক সময় উঠোনে মন্ডল করে তার চারপাশে চারা তৈরি করেও মাঝখানে কার্তিক প্রতিমা রাখা হয়। পুজোর ঘট ছাড়াও প্রতিমার সামনে কতকগুলো ছোটো ঘট রেখে তাতে চাল ও ফল দেওয়া হয়।

২. মুঠ উত্‍সব

‘গণদেবতা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, “…কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কল্যাণ করিয়া আড়াই মুঠা কাটিয়া লক্ষ্মীপূজা হইয়া গিয়াছে…।” এই ‘মুঠ’ উত্‍সব বা ‘মুঠ লক্ষ্মী’র পুজো অঞ্চল বিশেষে তা পয়লা অঘ্রাণও অনুষ্ঠিত হয়। “….সকালে উঠে স্নান করে, শাঁখ বাজিয়ে গঙ্গাজল, সিঁদূর, তুলো নিয়ে যাওয়া হয় ধানক্ষেতে। ক্ষেতের ঈশান কোণের আড়াই ঝাড় ধানগাছের ওপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে, সিঁদূর দিয়ে ওই আড়াই ঝাড় ধান কেটে ক্ষেতের কাটা ধানগাছের গোড়ায় সিঁদূর মাখা তুলো রেখে, কাটা আড়াই ঝাড় ধানগাছ কলাবৌ-এর মতো পাট, রেশম বা চেলি কাপড়ে মুড়ে শাঁখ বাজিয়ে আনা হয় বাড়িতে” (নৃপেন্দ্র ভট্টাচার্য, ১৩৭৪)। এই মুঠ উত্‍সবে উঠোনে দেওয়া হয় আলপনা, তার উপর রাখা হয় আলপনা আঁকা পিঁড়ি। ‘মুঠ ধান’ বহনকারী ব্যক্তি এসে দাঁড়ায় সেই পিঁড়িতে। ঘটা করে ধুইয়ে দেওয়া হয় তার পা। এই ধান পুজো করে তুলে রাখা হয়; পরে পৌষমাসে লক্ষ্মীপুজোয় কাজে লাগে — তার খড় রাখা হয় লক্ষ্মীর ঝাঁপি, ধানের গোলা, চালের হাঁড়িতে।

৩. আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর শেষ দিন:

পূর্বপুরুষ কিংবা লক্ষ্মীনারায়ণের উদ্দেশ্যে তিলতেল বা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয় স্তম্ভের মাথায়, বাড়ির ছাদ বা টালির চালে কিংবা তুলসী তলায়। আজকাল মোমবাতি বা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর রেওয়াজ হয়েছে। কার্তিক সংক্রান্তিতেই আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর সমাপ্তি।

চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা…কোথা থেকে এল এই কথা?

আবার বিভিন্ন উৎস থেকে ভিন্ন ভিন্নকিছু তথ্য জানাযায়। চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড় ধরা। এই কথা আমাদের খুব চেনা। প্রাচীন ভারতে চৌর্যবিদ্যা একটি কলা হিসেবে স্বীকৃত হত। বাৎসায়ণ তাঁর ‘কামসূত্রম্‌’-এ এই কথা স্বীকার করে বলেছেন – “হস্তলাঘবম্,…ইতি চতুঃষষ্টিরঙ্গবিদ্যাঃ কামসূত্রস্যাবয়বিন্যঃ”। চুরি যেহেতু এক প্রকারের কলা বা আর্ট, সেজন্য চোরেরা গৃহস্থের বাড়িতে এমনভাবে সিঁদ কাটবে, যা এক প্রকারের দৃষ্টনন্দন স্থাপত্য রূপে বিবেচিত হবে এবং নগরবাসীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই চৌর্যকর্ম দেখে চোরের নিন্দা করলেও তার শৈল্পিক গুণের প্রশংসা না করে পারবে না। আবার চুরি যেহেতু আর্ট, ফলে চোর যখন জনসমক্ষে আসবে, নিজেকে অত্যন্ত সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে নিজেকে সকলের সামনে উপস্থাপন করবে। এই চৌর্যকলাবিদ্যার প্রবর্তক হলেন স্বয়ং ষণ্মুখ বা কার্তিক। যদিও বেদে রুদ্রকে চোরদের উপাস্যরূপে বন্দিত হতে দেখা যায় এবং বঙ্গদেশে চোরদের আরাধিতা হলেন কালী, তথাপি ‘ষণ্মুখকল্পম’ চৌর্যশাস্ত্রে তস্করদের উপাস্যরূপে পাওয়া যায় চৌরকার্তিক বা ষণ্মুখের নাম। মনে করা হয় যে তিনি তাঁর শিষ্য তস্করদেরর চৌর্যবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন; কিন্তু তখন তা লিপিবদ্ধ করা হয়নি। গুরুশিষ্যপরম্পরায় স্মৃতিতে রক্ষিত হত। এর বহু পরে মঙ্গল নামে কোনও এক আচার্য এই অবলুপ্তপ্রায় চৌর্যশাস্ত্রটি লিপিবদ্ধ করার তাগিদ অনুভব করেন। চৌর্যশাস্ত্র সংক্রান্ত দুটি পুঁথির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত ‘ষণ্মুখকল্প’ অপরটি পুণের ভাণ্ডারকর অরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এ রক্ষিত ‘চৌরচর্য্যা’। চৌর্যশাস্ত্রের প্রবর্তক ও তস্করাধিপতি কার্তিক ছয় মুখ দিয়ে ছয় কৃত্তিকার স্তন পান করার জন্য তিনি ষণ্মুখ। সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত পৌরাণিক অভিধান অনুসারে, সপ্তর্ষি, মানে ব্রহ্মার মানসপুত্র সাত জন ঋষি – মারীচ, অত্রি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু, অঙ্গিরা ও বশিষ্ঠ, যাঁরা সপ্তর্ষিমণ্ডল নামে অবস্থান করেন আকাশের ঈশান কোনে, এই ঋষিদের মধ্যে বশিষ্ঠর স্ত্রী অরুন্ধতী বাদে, বাকি ছয় জনের স্ত্রী হলেন কার্ত্তিকের ছয় মা। ছয় কৃত্তিকা। এঁরা একদিন সকালে গঙ্গাস্নানে গিয়ে অগ্নি সেবন করেন। সেই অগ্নির তেজে তাঁরা গর্ভবতী হন। পরে তাঁরা সকলেই সেই তেজ হিমালয় শিখরে পরিত্যাগ করেন। সেই মিলিত তেজঃপুঞ্জ থেকে জন্ম হয় কার্তিকের। কার্তিকের ছয় মায়ের নাম যথাক্রমে কলা, অনসূয়া, ক্ষমা, হবির্ভূ, সন্নতি এবং শ্রদ্ধা। ছয় মায়ের স্তন্যপান করতে হবে বলেই কার্তিকের ছয় মস্তক, দ্বাদশ কর্ণ, দ্বাদশ চক্ষু, দ্বাদশ বাহু, এক গ্রীবা এক জঠরবিশিষ্ট। তাই তিনি ‘ষড়ানন’। কার্তিকের ১২ হাতে যে অস্ত্র থাকে তা চুরির কাজে লাগে, এমনই মত পন্ডিতগণের। আর কার্তিকের যে বাহন ময়ূর, সেটা কার্তিককে দিয়েছিল ঋষি কাশ্যপ এবং তার স্ত্রী বিনতার পুত্র ও বিষ্ণুর বাহন গরুড়। এই কার্তিকের স্ত্রী হলেন দেবসেনা, যিনি ষষ্ঠীরূপে পরিচিত। তবে এটাও বলার কার্তিকের ভাই গণেশও কোথাও কোথাও চৌরগণেশরূপে পরিচিত। সেইজন্য বলা হব, জপের সময় অঙ্গুলিসন্ধি ছাড়লে চৌরগণেশ জপের ফল হরণ করে। — সূত্রঃ চৌর্য সমীক্ষা ( ড. পুরীপ্রিয়া কুণ্ডু)

শেষ কথা

হ্যা আমাদের ভারতীয় মতানুযায়ী ও স্পেশালি বাঙালিদের মতানুযায়ী কার্তিক ঠাকুরকে সন্তানরূপ বলে মনে করা হয়। কার্তিক মাসে কার্তিক পুজো প্রায় মোটামুটি সব ঘরে ঘরে হয়ে থাকে। তবে লক্ষী পুজোর মতন অত জাঁকজমক করে না হলেও মোটামুটি খুব একটা খারাপও হয় না। বেশির ভাগ সন্তানহীন, সদ্য বিবাহ দাম্পত্য, ইত্যাদি পরিবারের মানুষরা এই পুজো করে থাকে। বাড়ি বাড়ি মজা করে বখাটে ছোড়ারাও কার্তিক ফেলার জন্য আগের দিন থেকেই প্রস্তুত থাকে। যার বাড়িতে কার্তিক ফেলবে বা রেখে আসবে তাদের শুধু ঘুমানোর জন্য অপেক্ষা করে থাকে আর যেই ঘুমিয়ে পরে অমনি কার্তিক ফেলার বা রাখার ধুম চলে তোর জোর।

সোর্সঃ সংগৃহিত

error: Content is protected !! Without permission do not copy the content. We will sue you if you copy the content without permission.